কাছে আসার গল্প


প্রথমে ছিল: কাছে আসার গল্প… ভালোবাসার টানে, কাছে আনে।

এরপর হইল: কাছে আসার ‘সাহসী’ গল্প।

এরপর হইসে: ‘দ্বিধাহীন’ কাছে আসার গল্প।

নাটক-সিনেমা-উপন্যাসের সবচে’ বড় সমস্যা বাই ডিফল্ট যেটা, সেটা হল জীবনের আংশিক চিত্র। এবং এই আংশিক চিত্রটুকুকে এতো সুন্দর এতো পবিত্র-আরাধ্য করে উপস্থাপন করা হয় যে, পুরো জীবনবোধই রিডিউস হয়ে কখনও প্রেম, কখনও বিরাট প্রতিষ্ঠিত হওয়া এগুলোর খাপে গিয়ে ঢোকে। এটা বাইডিফল্টই এমন। যেহেতু ২/৩ ঘন্টার সিনেমা, ৩০ মিনিটের নাটক, ২০০ পৃষ্ঠার উপন্যাসে পুরোজীবন আনা সম্ভব না কিংবা জীবনের একটা অংশের উপস্থাপনই উদ্দেশ্য থাকে।

সমস্যা হয় পাঠক-দর্শকদের। বিশেষ বয়সী পাঠক-দর্শকরা নিজেকে হারিয়ে ফেলে এতে। একাকার হয়ে যায় চরিত্রে-কাহিনীতে-এই পরিসরটুকুতে- ৩ ঘণ্টায় বা ২০০ পৃষ্ঠায়। জীবনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য-অর্থ সবকিছুকে রিডিউস করে নেয়। কখনও হিমুর মতো ড্যামকেয়ার হওয়া, বা দেবদাসের মতো তিলে তিলে শেষ হয়ে প্রেমের প্রমাণ দেয়া, প্রেমের জন্য আত্মহত্যা ইত্যাদি তার কাছে গ্লোরিফাইড হয়। প্রথম চোখাচোখি থেকে প্রেম, অনেক বাধা পেরিয়ে শেষদৃশ্যে মিলন বা মিলন হবে-হবে ভাব। কাছে আসার গল্প শেষ। কিন্তু এতো গেল জীবনের একটা দৃশ্য। এরপর?

পরিবার/সমাজের ভয় না করে ‘সাহসী’ গল্প বা মনের ভিতর নানান দ্বিধা ভেঙে ‘দ্বিধাহীন’ কাছে আসার গল্পের শেষটা আপনাকে দেখানো হবে মেয়েটা ছেলেটার দুইকাঁধে হাত রাখল, ছেলেটা মেয়েটার কোমরে দুইহাত রাখলো। শেষ। এই পর্যন্তই। এই প্রেম প্রেম ব্যাপারটা ছাড়া জীবনের আরও অনেক বাস্তবতা ছেলেটা-মেয়েটার সামনে ছিল… একাডেমিক রেজাল্ট ছিল, ভালো একটা চাকরি পেয়ে পরিবারের হাল ধরা ছিল, অসু্স্থ মা-বাপ ছিল। কাছে আসাটাই তার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য ছিল না। ছিল না একমাত্র আরাধ্য ইলাহ (যার বেদীতে আর সব অর্থগুলোকে বলি দিতে হবে)। কাছে আসার ‘বাধাগুলো’ও তার কাছে এর আগে আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল, বা এখনও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এই ‘কাছে আসা’র মওসুমী তাড়না তাকে তার জীবনের আসল কর্তব্য, পরম লক্ষ্য, অর্থ-উদ্দেশ্য সব ভুলিয়ে দিয়েছে। এবং জীবনের অন্যান্য উদ্দেশ্যকে ‘কাছে আসার’ বেদীতে বলি দেয়া শেখাচ্ছে এইসব ‘কাছে আসার গল্প’ প্রচারকরা।

কাছে আসার গল্পটা শেষ হবে। সিনেমা শেষে হল ভাঙবে। গল্প শেষে বইটা বন্ধ হবে। কল্পনার রেশ শেষে আপনি নেমে আসবেন বাস্তব মর্ত্যে। এরপরের গল্পটা আপনাকে এরা কেউ শোনাবে না। কেননা এরপরের গল্পটা সুন্দর না। পরের গল্পটা…

* হয়, বিয়ের প্রলোভনে (কাছে এসে) ধর্ষণের অজস্র মামলা।

* কিংবা, (একাকী আরও কাছে এসে) উপর্যুপরি রুম ডেট… গর্ভধারণ… উপর্যুপরি ইমার্জেন্সি পিল… উপর্যুপরি এমআর… রাস্তাঘাটে নবজাতক বা মানব ভ্রূণ।

* কিংবা দ্বিধাভেঙে কাছে এসে ঢাকায় নিয়ে হোটেলে তুলে সব চুরি করে প্রেমিকের পালিয়ে যাওয়া (হোটেল মালিক উসুল করবে)।

* বা, কাছে আসার পর কয়েকবন্ধু মিলে…

* বা, খালি বাসায় কাছে এসে লাশ হয়ে ফিরল অমুক।

* বা, কাছে আসি আসি বলে জোছনা ফাঁকি দিয়ে দিল। মজনু এখন বাবাখোর বা ডাইলখোর।

* বা, সব দ্বিধা ভেঙে ক্যাম্পাসের মশহুর চরিত্রহীনা মেয়েটাকে কাছে এনে আত্মহত্যা করে মাশুল দিল ডা. আকাশ।

* কিংবা, সাহসী ডা. তানজীর নিজে এক বছর ড্রপ দিয়ে প্রেমিকাকে কাছে এনে আত্মহত্যা করেছে।

* কিংবা, সমবয়েসী বয়ফ্রেন্ডকে বিয়ে করার জন্য ইচ্ছে করে ৩ বার ফেল করে মেয়েটি গিয়ে দেখল স্বামীর সাথে শোয়ারই জায়গা নেই শ্বশুরবাড়িতে। অথচ কত দ্বিধা ভেঙ্গেই কাছে গিয়েছিল।

* ৮ বছরের প্রেমের পর বিয়ে। অতঃপর ৬ মাসে ডিভোর্স।

কাছে আসার গল্প একটা ‘অবৈজ্ঞানিক’ গল্প। বিজ্ঞানান্ধ প্রজন্ম হড় হড় করে গিলবে এই অবৈজ্ঞানিক গল্প। পশ্চিমা একাডেমিয়াতে প্রচুর রিসার্চ হয়েছে একাডেমিক জীবনে রোমান্টিক সম্পর্কের ইন্টারপার্সোনাল স্ট্রেস কীভাবে শিক্ষার ক্ষতি করে, কীভাবে মাদকাসক্তি ও আত্মহত্যার হার বাড়ায়। বিজ্ঞানান্ধ প্রজন্মের কাছে এই পয়েন্টে এসে বিজ্ঞানের কোনো মূল্য নেই, কেননা বিজ্ঞান এখানে প্রবৃত্তির বিপক্ষে। শুধু যতটুকুতে বিজ্ঞান খায়েশের পক্ষে কথা বলবে, ধর্ম-সমাজ ভেঙে দিয়ে আধুনিকতার কথা বলবে ততটুকুই বিজ্ঞান গ্রহণযোগ্য। যেখানে বিজ্ঞান ধর্ম-সমাজের সাথে সুর মেলাবে সেই বিজ্ঞানটুকুকে আর পাত্তা দেয়া হবে না।

তার মানে বিজ্ঞান মানার দাবিকারীরা আসলে বিজ্ঞানও মানে না। তারা মানে এক মহাদর্শনকে যা চালায় বিজ্ঞানকেও… ঠিক করে দেয় বিজ্ঞানের সীমা। ইউনিলিভারের মতো আধুনিক ‘ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি’গুলো তাদের প্রয়োজনেই বিজ্ঞানের গবেষণাকে সাইডে রেখে মগজে চাপিয়ে দেয় অবৈজ্ঞানিক সব ‘কাছে আসার গল্প’।

অশ্লীলতার বিরুদ্ধে দুর্বার প্রতিরোধ গড়ে তুলুন।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *