হৃদয় মণ্ডল কাণ্ড: ছাত্রদের ভুল


বিজ্ঞান শিক্ষক হৃদয় মণ্ডল ও ছাত্রদের কথোপকথন পড়লাম। #হৃদয়_মণ্ডল এর পুরো অবস্থানটাই খোদ বিজ্ঞানের দৃষ্টিতেও ভুল। টিপিক্যাল #বিজ্ঞানবাদী দার্শনিক অবস্থান। ধর্ম ও বিজ্ঞানের তুলনা করে বিজ্ঞানকে শ্রেষ্ঠ ও ধর্মকে হেয় করার শুরুটা তিনিই করেছেন বলে মনে হলো। অথচ বিজ্ঞানের বিষয় ফিজিক্যাল ওয়ার্ল্ড নিয়ে আর ধর্মের আলাপ ‘মেটাফিজিক্যাল ওয়ার্ল্ড’ নিয়ে (ইসলাম ব্যতিক্রম)। সুতরাং ধর্ম নিয়ে বিজ্ঞানের যতগুলো তুলনা তিনি করেছেন, প্রতিটাই ভুল। তুলনা হয় একই জাতীয় জিনিসের। আরও কিছু টিপিক্যাল বস্তুবাদী নাস্তিক্যবাদী অবস্থান থেকে ভুল তুলনা, ভুল যুক্তি তিনি দিয়েছেন। সেগুলো পরে আলাপ করা যাবে।

কাফিররা কুরআন-হাদিস থেকে বিজ্ঞান বের করেছে?

আজ আমি কথা বলতে চাই ছাত্রদের ভুল অবস্থানটা নিয়ে। সেটা হল, এই ছাত্ররা এবং মুসলিমদের বিরাট একটা অংশ মনে করে পশ্চিমারা কুরআন হাদিস গবেষণা করে #বিজ্ঞান বের করে। আমি জানিনা এর পিছনে কাদের দায়ী করব। ওয়াজগুলো এমন ধারণার একটা উৎস বলে মনে হয়। দেখুন, কুরআনে সব যুগের সব ইন্টেলেক্টের সব বিষয়ের জ্ঞানী অনুসন্ধানী মানুষের খোরাক দেয়া আছে। নবিজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আল্লাহ মানুষের জন্য মডেল হিসেবে প্রেরণ করেছেন। তাঁর সুন্নাহ সমূহ মানুষের সাইকোলজি-বায়োলজির পক্ষে সর্বোচ্চ কল্যাণদায়ী। মানুষের পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা বেড়েছে বলে নানা রিসার্চে এগুলো উঠে আসছে। (অধমের কষ্টিপাথর ১-২-৩ দ্রষ্টব্য)

<image1>
<image2>
<image3>

আমি নিজেও নন-কমিউনিকেবল ডিজিজ নিয়ন্ত্রণে মানুষকে স্বাস্থ্যকর জীবনমুখী করতে ইমাম-খতিবদের ইনভলভ করে নবিজির দৈনন্দিন সুন্নাহগুলো প্রমোট করার একটা ইনোভেশন নিয়ে সরকারের সাথে কাজ করার প্ল্যান সাবমিট করেছি। ‘বিজ্ঞানের উন্নতি’র দরুণ এগুলো আরও ভালোভাবে বুঝা যাচ্ছে। কিন্তু ‘বিজ্ঞানের উন্নতিটাই’ হয়েছে কুরআন-হাদিস গবেষণা করে, এই দাবিটা যুক্তিযুক্ত না। কারা এই কথাটা আমাদের মাথায় ঢুকিয়েছে আমার জানা নাই। একটা হাদিস বলি। বিখ্যাত হাদিস। পরাগায়নের হাদিস।

<image4>
<image5>

নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আর্টিফিসিয়াল পরাগায়ন করতে নিষেধ করেন। ফলে ঐ বছর ফলন কমে যায়। নবিজিকে জানানো হলে তিনি বলেন: যেসব কথা দীনের ব্যাপারে নয়, তেমন কিছু কথা আমি নিজের ধ্যানধারণা থেকেও বলি। আমিও মানুষ। অর্থাৎ কৃষিকাজে তোমাদের অভিজ্ঞতা আমার চেয়ে বেশি। দীনের ব্যাপারে আমাকে মানা জরুরি, প্রযুক্তিগত-পর্যবেক্ষণগত বিষয়ে নয়। সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। দেখুন, আর্টিফিসিয়াল পরাগায়ন একটা প্রযুক্তি। এই হাদিস থেকে বুঝা যায় ভৌতবিজ্ঞান নিয়ে ইসলাম আসেনি। ভৌতবিজ্ঞান বা ন্যাচারাল সায়েন্সকে (ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি, ম্যাথ, ইন্জিনিয়ারিং, বায়োলজি) ইসলাম মানুষের অভিজ্ঞতা-গবেষণার উপর ছেড়ে দিয়েছে। কুরআন-ইসলামের আলাপ ‘মানুষ’ নিয়ে… হিউম্যান সায়েন্স। মানুষের আকীদা, মানুষের নৈতিকতা, মানুষের জীবনযাপন, মানুষের পরিবার-সমাজ-রাষ্ট্র, মানুষের অর্থনীতি-আইন। এসব বিষয়ে ইসলামের সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। যার কল্যাণ, মানুষের বায়োলজি-সাইকোলজি-ইকোলজি-সোশিওবায়োলজির সাথে যার প্রাসঙ্গিকতা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে নিরপেক্ষ গবেষণায় প্রমাণ করা সম্ভব। কিন্তু এর মানে এই না, পশ্চিমারা কুরআন-হাদিস ঘেঁটে ঘেঁটে পদার্থ-রসায়ন-চিকিৎসা-প্রকৌশলে উন্নতি করছে। কথাটা অযৌক্তিক ও হাস্যকর। ইসলাম নিজেও এটা দাবি করে না।

কুরআনে কি সব আছে?

#কুরআন কী? সূরা বাকারার ২য় আয়াতে কুরআন নিজের পরিচয় দিয়েছে ‘হুদাল লিল মুত্তাকীন’। ‘তাকওয়াবানদের জন্য পথনির্দেশ’। অথচ পশ্চিমের চোখ ধাঁধানো উন্নতিতে হীনম্মন্য মুসলিম মন কুরআনকে ‘বিজ্ঞানের বই’ বানিয়ে সান্ত্বনা খুঁজেছে। জোর করে ‘কুরআনুল হাকীম’ এর অর্থ করেছে ‘বিজ্ঞানময় কুরআন’। অথচ বিজ্ঞান এক জিনিস, প্রজ্ঞা/হিকমাহ আরেক জিনিস।

কুরআন আল্লাহর দেয়া পথনির্দেশ। পথের খোঁজ। যে আল্লাহকে রাজি করতে চায়, তার জন্য। যখন আমরা বলেছি ‘ইহদিনাস সিরাতাল মুস্তাকীম’ (সরল পথের খোঁজ দাও)। আল্লাহ বলেছেন: এই নাও, এই সেই কিতাব যাতে সন্দেহ নেই। এটাই তোমাদের পথের দিশা। একে অনুসরণ করে জীবন পরিচালনা করলে সরল পথ পেলে। এটা খুব বুঝার আছে। কুরআন একজন মুসলিমের পুরো জীবন পরিচালনার গাইডলাইন। ব্যস। একজন মুসলিম বিজ্ঞানী, একজন মুসলিম কৃষক, একজন মুসলিম গৃহিনী, একজন মুসলিম কিশোর, একজন মুসলিম সৈনিক, একজন মুসলিম শাসকের জন্য জীবন পরিচালনার কমন নীতিমালা

বিজ্ঞানীর পেশাগত জীবনে যে অতিরিক্তটুকু লাগবে, কৃষকের কৃষিকাজে, গৃহিনীর রান্নায়, সৈনিকের কৌশলে যে বিষয়ভিত্তিক বিশেষ জ্ঞান লাগবে। তাও কি আছে কুরআনে? তার নির্দেশনা আছে, যেহেতু কুরআন নির্দেশনারই কিতাব। তা হল:

‘যে বিষয়ে তোমার জ্ঞান নেই সেটা, যে জানে তার থেকে জেনে নাও’।

কুরআনে ‘সব’ নেই। তবে ‘সব’ বিষয়ে নির্দেশনা আছে। যারা বলে ‘সব’ আছে, তারা এই নির্দেশনা অর্থেই বলে। কিন্তু ছাত্ররা সেটা বলেনি। তাদের দাবি ছিল কুরআনে সব আছে, পশ্চিমারা সেসব রিসার্চ করে বিজ্ঞানের নানান থিওরি আবিষ্কার করেছে। এই দাবি বাস্তবতা-বিবর্জিত ও ছেলেমানুষি কথা।

ব্যাপারটা হয়েছে কী? #হৃদয়_মন্ডল বিজ্ঞান জানে না এবং ছাত্ররা ইসলাম জানে না। ফলে যা হবার তা-ই হয়েছে। দুপক্ষই আবেগ দিয়ে যাচ্ছেতাই বলেছে।

আল্লাহ কলম সৃষ্টি করেছেন সবার আগে। এরপর বলেছেন: লেখো, কিয়ামত তক যা যা হবে, লেখো। কলম লিখেছে। সব লেখা আছে। কোথায়? লওহে মাহফুজে… সুরক্ষিত মহা ফলকে। কুরআনও লেখা রয়েছে সে ফলকে। সেই ফলক থেকে কুরআন অংশটুকু শবে কদরে ১ম আসমানে নাযিল হয়েছে। এরপর ২৩ বছর ধরে একটু একটু করে দুনিয়ায় এসেছে। সব লেখা আছে। সেটা কুরআনে নয়। কুরআনে আছে কেবল জীবন পরিচালনার সাধারণ নির্দেশিকা। সব লেখা আছে লওহে মাহফুজে। সব আছে আল্লাহর ইলমে। আর কুরআন আল্লাহর ইলমের একটা সামান্য ব্যবহারিক অংশ, যা মানবজাতির ব্যবহারিক প্রয়োজনে লাগবে।

এক শ্রেণীর লেখক ‘বিজ্ঞানময় কুরআন’, ‘কুরআনে বিজ্ঞান’, ‘বিজ্ঞানের জ্ঞানের আলোকে কুরআন’, ‘পদার্থবিজ্ঞানের চোখে মেরাজ’ ইত্যাদি নানা নামে লিখে গেছেন বইপত্র। সেখানে প্রয়োজনে আয়াতকে ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে অর্থ বিকৃত করে বিজ্ঞানের বই বানিয়ে ছাড়া হয়েছে কুরআনকে। কুরআনে সব আছে এবং কুরআন বৈজ্ঞানিক তথ্যসমৃদ্ধ। এই দুয়ে মিলে দাঁড়িয়েছে ছাত্রদের দাবিটা। যে দাবিটা একই সাথে অবৈজ্ঞানিক ও অনৈসলামিক।

টীচাররা এসব বিজ্ঞানবাদী কথাবার্তা বললে আমি এনগেজ হওয়ার পক্ষে না। বরং আমি আমাদের কনসেপ্ট ও বয়ান ক্লিয়ার করা ও চর্চার পক্ষে। আমাদের যেতে হবে আরও দূর।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *