সাম্প্রদায়িকতা


আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে মারাটাকে কি কেউ সাম্প্রদায়িক সহিংসতা বলবেন? শিবির সন্দেহে হত্যা? কিংবা শিবির-ছাত্রদল সন্দেহে গণগ্রেপ্তারকে সাম্প্রদায়িক নির্যাতন বলবেন না? এই যে ছাত্রলীগ করার সময় যখন শিবিরকে হল থেকে বের করে দিয়েছিলাম, এটাকে সাম্প্রদায়িক উচ্ছেদ বলা হবে কি না। যখন আমরা শ্লোগান দিতাম ‘একটা একটা শিবির ধর, ধইরা ধইরা জবাই কর’; এটাকে ঠিক কী কারণে সাম্প্রদায়িক উগ্রতা বলা হবে না?

গণজাগরণ মঞ্চের ‘মঞ্চ’ থেকে ইসলামবিরোধী বক্তব্যকে কেউ ‘সাম্প্রদায়িক’ বক্তব্য বলেনি কিন্তু। কিন্তু হুজুরদের ওয়াজে নাস্তিকবিরোধী কথা কিন্তু আবার উগ্র সাম্প্রদায়িকতা। মুক্তমনা, ধর্মকারী ইত্যাদি হাজারও নাস্তিক সাইটে নবিজি-আম্মাজান-জিবরীল-আল্লাহকে নিয়ে চটি লেখাকে কেউ সাম্প্রদায়িক বলে না। যেমন বলে না ঘরহারা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের লক্ষ্য করে ‘তৈল ঢালা স্নিগ্ধ তনু’ এলিট বাঙালিদের কুৎসিত মন্তব্যগুলোকে।

ধর্মকে হেয়, অপ্রয়োজনীয়, ভিলেন হিসেবে চিহ্নিত করার ইউরোপীয় ক্যাপিটালিস্ট প্রকল্প-এর আরেকটি মুখরোচক শব্দ ‘সাম্প্রদায়িকতা’। সাম্প্রদায়িকতা শব্দটাকে রিডিউস করে কেবল ধর্মের ক্ষেত্রেই স্থির করা। ইউরোপে এনলাইটেনইমেন্ট পরবর্তী বিশ্বে ধর্মকে উচ্ছেদ করা হল সব জায়গা থেকে। ইউরোপের (শুধু ইউরোপের) হাজার বছরের ভোগান্তির পিছনে দায়ী এই ধর্ম-ই (পোপতন্ত্র)। মডার্নিটিতে এসে, উনিশ শতকে মাঝামাঝি সময়ে এক ধর্মীয় সম্প্রদায়ের অন্য ধর্মীয় সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষমূলক বা ঘৃণার ভাবকে বুঝাতে communalism শব্দটি প্রথম ব্যবহার করা হয়। অর্থাৎ বাই ডেফিনেশন, সাম্প্রদায়িকতা ধর্মীয়-ই হতে হবে। যদিও ধর্মকে ছাপিয়ে সাম্প্রদায়িকতার অর্থ এখন ব্যাপক। কিন্তু ইউরোপীয় মডার্নিটি-প্রভাবিত আমাদের নেটিভ মন সাম্প্রদায়িকতাকে শুধুমাত্র ধর্মেরই ইলিমেন্ট হিসেবে খেয়ে নিয়েছে, আর বের হবার নাম নেই। বদরুদ্দিন উমর সংজ্ঞা দিচ্ছেন:

‘কোন ব্যক্তির মনোভাবকে তখনই সাম্প্রদায়িক বলে আখ্যা দেওয়া হয় যখন সে এক বিশেষ ধর্মীয় সম্প্রদায়ভুক্তির ভিত্তিতে অন্য এক ধর্মীয় সম্প্রদায় এবং তার অন্তর্ভুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধচারণ এবং ক্ষতিসাধন করতে প্রস্তুত থাকে’।

আবার সেই ধর্ম-ই। এ ক্ষেত্রে কোন ব্যক্তিবিশেষের ক্ষতিসাধন করার ইচ্ছাটা সেই ব্যক্তির সাথে সাক্ষাৎ পরিচয় অথবা বিরুদ্ধতা থেকে সৃষ্ট নয়। ব্যক্তিবিশেষের প্রতি শত্রুতা এ ক্ষেত্রে গৌণ, মুখ্য হলো সম্প্রদায়। তাহলে, ধর্মনিরপেক্ষতার নামে যে সম্প্রদায়গুলো তৈরি হয়েছে, সেগুলো ভিত্তি করে যে ঘৃণার চাষ, সেগুলোকে সাম্প্রদায়িকতা বলা হচ্ছে না কেন? ডেমোক্রেসি-তে রাজনৈতিক বহুদলে যে ঘৃণা, উগ্রতা, সহিংসতা… তা তো ধর্মীয় সহিংসতাকে ছাড়িয়ে গেছে। হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা কতবার হয়, আর ছাত্রলীগের দুইগ্রুপে মারামারি কয়বার হয় বছরে। অন্য দল যে আছে, তা আমি ব্যক্তিগতভাবে ভুলেই গেছি। চোখের সামনে যা আছে, তা-ই বলছি। পৃথিবীতে যেসব যুদ্ধে সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা গেছে সেগুলো ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির বলি (সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, উগ্র জাতিবাদ, লিবারেল সেক্যুলারিজম প্রতিষ্ঠা)।এগুলোকে কেন সাম্প্রদায়িকতা হিসেবে দেখছেন না।

ইসরাইলকে সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র বলেন অনেকেই। কিন্তু ডেমোক্রেসির সর্বোচ্চ উদাহরণ আমেরিকার জনগণ যে এই সাম্প্রদায়িক পলিসি পরিবর্তন করতে আগ্রহী না, আমেরিকার জনগণকে কেন সাম্প্রদায়িক বলা হচ্ছে না? আফগান আক্রমণের কারণ আছে, বুঝলাম ৯/১১। কিন্তু ইরাক আক্রমণ থেকে নিজ দেশকে তারা কেন ফেরাতে পারলো না, যদি জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস হয়ে থাকে সে দেশে। কেবল ‘আমেরিকার চশমায় দেখতে রাজি না’, এজন্য ইরাক-লিবিয়ায় হামলাকে কেন আদর্শিক সাম্প্রদায়িকতা বলবেন না?রোহিঙ্গারা জাতিগত বাঙালি, মুসলমান। স্রেফ র‍্যাডক্লিফের দাগের ভিতর না আসার কারণে যে ঘৃণার ছড়াছড়ি সেক্যুলার এলিট শিক্ষিৎ মহল করল, এটাকে সাম্প্রদায়িকতা বলবেন না?

পুরো একটা সম্প্রদায়কে শত্রু কি কেবল ধর্ম ভাবে? ধর্ম যদি ভাবে, সেক্যুলার মহল আরও বেশি ভাবে, ভাবতে শেখায়। সেক্যুলারাইযেশন প্রক্রিয়া থেকে উদ্ভূত প্রতিটি মতবাদ এটাই শেখায়। শুধু আপনার মতো করে চিন্তা না করার কারণে আপনি পুরো একটা গোষ্ঠীর প্রতি বিদ্বেষ রাখেন কিনা সবাই ভেবে দেখবেন। পুরো শিবির, পুরো বিএনপি, পুরো আওয়ামী লীগ, পুরো রোহিঙ্গা, পুরো বিএনসি (বরিশাল-নোয়াখালি-কুমিল্লা), পুরো মাদরাসাপড়ুয়া ইত্যাদি ইত্যাদি।

দুনিয়ার তাবৎ সমাজ-গোষ্ঠী-দল-পার্টির ইলিমেন্ট সাম্প্রদায়িকতা। ‘ওর চেয়ে আমি কেন শ্রেষ্ঠ’ এই সাম্প্রদায়িকতার ব্যবসা করেই সেক্যুলার সমাজে, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে প্রতিযোগিতা করতে হয়, পুরো বিশ্বে রাজ করতে হয়। সাম্প্রদায়িকতা কোনো ‘কেবল ধর্মীয়’ ইলিমেন্ট না, এটা ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ ইলিমেন্ট। ধর্মকে ভিত্তি করেও হয়, ধর্মকে বাদ দিয়েও হয়। এবং এটা কাইন্ড-অফ স্বতঃস্ফূর্ত। ধর্মনিরপেক্ষ গোষ্ঠীতেও হয়। যার আদর্শ আছে, সে সাম্প্রদায়িক স্বতঃস্ফূর্তভাবেই হয়। এক ইস্যুতে না হলেও আরেক ইস্যুতে হয়। যে কোনো কিছুর জন্য স্ট্যান্ড করে না, যার কোনো আদর্শ নেই, পানির মত তরল, কেবল তার মাঝেই কোনো বিষয়েই সাম্প্রদায়িকতা থাকে না। আপনার অবস্থানই (ধর্মীয়-দলীয়-আদর্শিক ইত্যাদি) শ্রেষ্ঠ যদি আপনি মানেন, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই আরেকজনের অবস্থান আপনার চোখে নিকৃষ্ট। ঘৃণা তো শুরু হয়ে গেছে, শুধু প্রকাশের অপেক্ষা। এক ক্ষেত্রে আপনি নিয়ন্ত্রণ করবেন, কখনো নিয়ন্ত্রণে থাকবে না। সুতরাং সাম্প্রদায়িকতা বিলোপের বিষয় নয়, নিয়ন্ত্রণের বিষয়। কী দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করবেন? ইনসাফ দিয়ে, ন্যায় দিয়ে। ন্যায় কীভাবে?

আবূ ফাসীলা রদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কোনো ব্যক্তি তার কওমকে ভালোবাসে, এটা কি আসাবিয়্যাহর (সাম্প্রদায়িকতা) অন্তর্ভুক্ত হবে?’ তিনি জবাব দিলেন, “না। (আসাবিয়্যাহ হলো) নিজের কওমকে জুলুমের ক্ষেত্রে সাহায্য করা।

যখন বুঝবো আমার সম্প্রদায়ের অপরাধ, তখন অপরাধকে আর সমর্থন করব না, অপরাধে আমার সম্প্রদায়কে সাহায্য করব না। নিজ আদর্শের, সমাজে, দলে fellow-feelings থাকবে, থাকতেই হবে। না থাকলে মানুষ গোষ্ঠীবদ্ধ হয়ে পারে না। সেই fellow-feelings যখন ন্যায়ের বিপরীতে বিজয়ী হয়ে যায়, তাকেই সাম্প্রদায়িকতা বলে। আর ন্যায়/ ইনসাফ যখন ফেলো-ফিলিংসকে পরাজিত করে, তখনই সাম্প্রদায়িকতা পরাজিত হয়। যে সমাজে ন্যায় নেই, সেখানে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা হবেই। গত ক’দিনের চিত্রের বিপরীত চিত্র কল্পনা করুন। প্রতিমার পায়ের উপর কুরআন পাওয়া গেছে। নগদে সেখানে আগেভাগেই দাঙ্গা পুলিশ মোতায়েন হয়ে গেল। ধর্মমন্ত্রী নিজে সেখানে গেলেন, দুঃখপ্রকাশ করলেন। পূজা কমিটি দুঃখপ্রকাশ করল। দোষীকে দ্রুত শাস্তি দেয়া হবে। সকলের সদিচ্ছা প্রকাশ পেল। দোষী (হিন্দু/মুসলিম যেই হোক) সাজা পেল, হয়ে গেল। কিন্তু সেটা হয়নি। বেলা বারোটা পর্যন্ত কুরআন পায়ের উপরেই ছিল, পূজা কমিটিও সরানোর প্রয়োজন মনে করেনি, মুসলিমরা বার বার বলার পরও গুরুত্ব দেয়নি। পুলিশও আসেনি, বেলা বারোটায় ওসি সাহেব নিজে এসে সরালেন। পূজা কমিটি একতরফা মুসলিমদের উপর বিষোদ্গার করল। তাৎক্ষণিক কোন সরকারদলীয় বড়সড় কেউ কোন আশ্বাস দিল না। ন্যায়ের কোনো আশাই নেই। হতাশা থেকে সাম্প্রদায়িকতার প্রকাশ ঘটলো দেশের নানা স্থানে। আপন আপন জায়গা থেকে সবাই সাম্প্রদায়িক বক্তব্যই দিল। সরকার বলল ‘বিএনপি জামাতের দোষ’, বিএনপি-বাম বলল: সরকারের ব্যর্থতা, হিন্দু বলল: মুসলমান মূর্তি ভেঙেছে, মুসলমান বলল: হিন্দু কুরআন রেখেছে। এভাবে হয় না, ভাই।

অসাম্প্রদায়িক বলে কোনোকিছুর অস্তিত্ব দুনিয়ায় নেই, এমনকি নাস্তিকরাও, কমিউনিস্টরাও। তবে, ন্যায়ের অস্তিত্ব আছে। মানুষের বিল্ট-ইন যা না, তা টেকসই না, প্রায়োগিক না। বইপত্রে থাকে, শুনতে ভালো শোনায়, এতোটুকুই।

আসল সমাধান হল: ন্যায়, ইনসাফ…আচ্ছা, দুনিয়ার বুকে ইনসাফ কি ছিলো কোনোদিন?

,

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *