চেপে যাওয়া ইতিহাস


<image>

এই লেখাটা লিখতাম না। সাম্প্রতিক সময়ে কিছু ঘটনা নৈতিকভাবে বাধ্য করল চিন্তাগুলো অভিজ্ঞতা গুলো শেয়ার করতে। বিষয়টা নিয়ে আমরা ডিসেনসিটাইজ হয়ে গেছি, মনে হচ্ছে। যাদের এই বিষয়ে সবচেয়ে ইনটলারেন্ট (সহ্য করার কথা না) হবার কথা ছিল, তাদের মাঝেই অদ্ভূত নীরবতা, ধামাচাপা দেবার চেষ্টা, ফরমেট পরিবর্তনের কোনো ইচ্ছাই না থাকা এগুলো আমাকে কষ্ট দেয়। কারণ আমি বিষয়টার আগাপাশতলা বুঝি, জানি এর ব্যাপ্তি ও ধরনধারণ।

আমি এক বিশেষ ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আমার কৈশোর পার করেছি। ক্লাস সেভেন থেকে ক্লাস টুয়েলভ। বয়ঃসন্ধি থেকে তারুণ্যের শুরু অব্দি। তখন এতকিছু বুঝতাম না, ইনফ্যাক্ট আমি আমার সহপাঠীদের চেয়ে কমই বুঝতাম সবকিছু, আমোদউল্লাসে মেতে থাকতে পছন্দ করতাম। ১২-১৮ বয়সটা আমাদের আবাসিক থাকতে হয়েছে। যখন সবকিছু বুঝার সময়, আবেগের সময়, আকর্ষণটা টের পাওয়ার সময়। এসময় চিন্তাভাবনা থাকে কম, আবেগ থাকে বেশি, অপরিণামদর্শী বয়স। তখন নতুন নতুন ক্লাস সেভেনে, বোর্ডিং জীবন, সিনিয়রদের বকাঝকা তখনও শুরু হয়নি। আমরা ঢুকলাম, আর এক ব্যাচ ২ মাস পর বেরিয়ে যাবে। তো বিদায়ী ব্যাচের এক নেতা (লীডার কর্তৃপক্ষ নিয়োগ দেয়, প্রিফেক্ট বলা হয়) আমাদের বাচ্চাকাচ্চাদের নিয়ে গল্পের আসর জমালেন। দাদু যেমন নাতিদের নিয়ে বসে। গভীর রাত অব্দি কত গল্প, কত কাহিনী, তাঁর ৬ বছরের জীবনের। আমরা বাচ্চারা খুব মজা নিয়ে শুনছিলাম। নারী-পুরুষ নর্মাল প্যাটার্নটা আমি বুঝতাম ক্লাস টু থেকে (খারাপ সঙ্গে পড়ে)। হঠাৎ ভাই এমন একটা কথা বললেন, আমার মত এঁচোড়ে পাকা ছেলেও আসমান থেকে পড়ল, বলে কী ভাই এগুলো? ভাই আমাদের সতর্ক করছিলেন, সিনিয়র কেউ রাতে লাইটস অফের পর রুমে ডাকলে যাবা না। একজন আরেকজনের বিছানায় লাইটস অফের পর থাকবানা। আদরের নামে আপত্তিকরভাবে শরীর স্পর্শ করলে আমাকে এসে জানাবা। আর আপত্তিকর কিছু ভয়ভীতি/প্রলোভন দেখিয়ে করতে চাইলে আগে টাস করে একটা চড় মারবা, তারপর আমাকে এসে বলবা, বা কোন সিনিয়র যাকে বিশ্বাস কর তাকে জানিয়ে রাখবা। সেদিন থেকে আমার চিন্তার জগত একটা বিরাট ঝাঁকি খেল। এও সম্ভব? আমি জানলাম, নারীপুরুষ স্বাভাবিক আকর্ষণের বাইরে একটা বিকৃত চিন্তার ধরন।

প্রতি ব্যাচেই কিছু না কিছু ঘটনা ঘটত। তবে সেগুলো প্রকাশ পেত না। ‘ব্যাচের বদনাম’ রোধে সেগুলোকে চেপে যাওয়া হত। প্রকাশ পেত শুধু সেগুলো, যেগুলোতে ঘটনাগুলো হত সিনিয়র-জুনিয়র। কারণ তখন জুনিয়র ব্যাচও ইনভলভড, সিনিয়র ব্যাচ কোন স্টেপ না নিলে জুনিয়র ব্যাচের কাছেও মানসম্মান থাকে না। সেসব ক্ষেত্রে অথোরিটিকে জানানো, বা নিজেরা শাসানো ইত্যাদি করা হতো। আমি এই মনস্তত্বটার প্রতি শুরু থেকেই কৌতূহলী, কেন এমন হয়? ‘গে-জীন’ মতবাদ আমাদের বলছে, সৃষ্টিগতভাবেই কেউ কেউ সমলিঙ্গের প্রতি আকর্ষিত হয়। তবে এই মত মেনে নেয়ার আগের বিষয়টা হল, এই মতের প্রবক্তা নিজেই সমকামী ছিলেন। তাই, বলে দেয়া যায় না যে, নিজের বিকৃতিকে একটা সামাজিক স্বীকৃতির রূপ দেবার মোটিভ তাঁর ছিলো না। আমি বিষয়টার মনস্তাত্ত্বিক দিক নিয়েও ভেবেছ, পড়াশুনো করার চেষ্টা করেছি। কলেজের শেষ বছরে হঠাৎই ঘটনাগুলো খুব বেড়ে গেল, আমরা সচেতন কয়েকজন ব্যাচের সম্মান বাঁচাতে দ্রুত কিছু স্টেপ নিলাম যাতে জুনিয়ররা পুরো ব্যাচটাকে না গাইলায়। সেসময় অনেক কিছু জানলাম। বিকৃতির বহু প্রকাশ, এমনকি নিজ ব্যাচের ভিতরকার অনেক চেপে রাখা কাহিনীও সামনে চলে এল।

সমকামী হবার পিছনে দুটো মূল কারণ আমার সিদ্ধান্তে এলো। দুটোই বয়সন্ধিকালের আগেই গড়ে ওঠে। মানে কারও সমকামী হয়ে ওঠাটা তার বয়ঃসন্ধির আগেই ঠিক হয়ে যায়। প্রথম কারণ, বোনদের মাঝে বেড়ে ওঠা। নিজের লৈঙ্গিক স্বকীয়তা অনুভব না করা। এরকম একাধিক কেস আমি পেয়েছি। দুই বা তিন বোনের এক ভাই। ছোটবেলা থেকেই বোনদের সাথে থাকে, বোনরা সাজায়, বোনরা ছেলেদের গল্প করে, সে শোনে, মুগ্ধ হয়। মা হয়তো ভাবে, বড় হলে ঠিক হয়ে যাবে। বাবাও কেয়ার করে না, বা সময় দেন না। ধীরে ধীরে নারীর বদলে পুরুষের প্রতি আকর্ষণ গড়ে ওঠে। অতীত নোংরা জীবন থেকে তাবলীগের মাধ্যমে দীনের বুঝ পেয়েছেন, এখন ট্রান্সজেন্ডার-হিজড়াদের মাঝে মেহনত করছেন, এক ভাই জানিয়েছেন: আপনারা যেমন নারী থেকে নজরের হিফাজত করেন, আমাকে সব ছেলে থেকে চোখ বাঁচিয়ে চলতে হয়। কত কষ্ট করে ইজতেমায় আসি আমি জানি। আরেক মেডিকেল পড়ুয়া, খুব চেষ্টা করছেন সংশোধনের, ৩ বোনের একভাই। বাবা প্রবাসী। ঝরঝর করে কেঁদে দিলেন, বাবা না থাকায়, বয়ঃসন্ধির আগে কেউ চিনিয়ে দেয়নি যে তুমি ছেলে। মেয়েদের মত সাজাতো বোনেরা, সবাই মজা পেত দেখে। ধীরে ধীরে নারীসুলভ মুভমেন্ট এসে গেল।

ইসলামের বিধান খুব ক্লিয়ারকাট। একটা বয়সের পর ভাইবোন এক বিছানায় শোবে না, একসাথে থাকবে না। পুরুষ কখনোই নারীর পোশাক পরবে না, নারী পুরুষের পোশাক পরবে না। বাবার সংস্পর্শে শিশু পুরুষ হয়ে ওঠে, শিশুরা বাবার মত হতে চায়। এজন্য বাবারা ছেলেশিশুদের সময় দেবেন। হাত ধরে মসজিদে নেয়া, একসাথে বল খেলা, বিকেলে বাবার হাত ধরে বেড়াতে নেয়া। এগুলো করতে হবে, বিশেষ করে যদি বড়বোনেরা থাকে, তাদের প্রভাব ও জীবনাচার থেকে শিশুকে বের করে আনতে হবে।

আর দ্বিতীয় কারণ হলো। খুব ভালো করে খেয়াল করতে হবে। এটাই আমার আলোচনার মূল কারণ। কলেজের ঘটনাগুলোর প্রায় শতভাগ ঘটনার একটা কমন বৈশিষ্ট্য ছিল। হয় একটিভ বা প্যাসিভ এজেন্টের একজন অবশ্যই পাওয়া যেত যে কলেজে ভর্তির জন্য আবাসিক কোচিং করত। আবাসিক ক্যাডেট কোচিংগুলো ক্লাস ফাইভ-সিক্স-সেভেন পড়িয়ে ক্যাডেট কলেজে সেভেনে ভর্তি পরীক্ষা দেয়ানো হয়। বড় বড় কিছু প্রথিতযশা কোচিং এ বাচ্চারা আবাসিক থাকে। ১০-১১-১২-১৩ বছর বয়সী সব বাচ্চা। কলেজে ঘটা ঘটনার প্রায় শতভাগে একজন থাকে যে এমন শিশু বয়সে আবাসিক কোচিং করেছে। এবং প্রথম অভিজ্ঞতাটা হয়েছে এখানে, বয়সে বড় কারো দ্বারা। সমকামের মনস্তত্ত্ব গড়ে ওঠার ২য় কারণ হলো, ছোটবেলায় সমকামের অভিজ্ঞতা বা ভিকটিম হওয়া। বয়ঃসন্ধির আগেই বিকৃত অভিজ্ঞতা তাকে পরিণত বয়সে সমকামী করে তোলে। আর পায়ুকামে ‘প্রোস্টেটিক ম্যাসাজ’ এর ফলে বীর্যপাতও হয়, ফলে একটা অভ্যস্ততাও কাজ করে। এই ছেলেগুলোই পরবর্তীতে কলেজে ভর্তি হয়ে হয় নতুন কাউকে প্ররোচিত করে, বা নিজের মতই কাউকে খুঁজে নেয়। একটা ব্যাচে ৫০-৫৫ টা ছেলের মধ্যে ১-২ জন এমন পাওয়া যেত। আবাসিক কোচিং থেকে যারা আসত, তারা সবাই এমন তা কখনোই নয়। তবে যারা এরকম, তাদের প্রায় শতভাগ আবাসিক কোচিং এর হিস্ট্রি আছে। মানে তাদের প্রথম এক্সপোজার হয়েছে কোচিং-এ।

আমার পয়েন্ট হচ্ছে, বিভিন্ন বয়সী বাচ্চাদের একসাথে আবাসিক রাখা একদমই অনুচিত, তাও এই পর্নোগ্রাফির যুগে। ১৫ বছর আগে তো পর্নো এত সহজলভ্য ছিল না, তাতেই এসব কেস হত। এখন তো বিকৃতির সুযোগ আরও বেশি। আর এমন বাচ্চাদের আবাসিক দেয়ার আমি ঘোর বিরোধী যাদের ভালোমন্দ বুঝার বয়স হয়নি। এদেরকে হুমকি ধামকি বা ভয়ভীতি দেখিয়ে বড় বয়েসীরা ভিকটিমাইজ করতে পারে। বয়সে বড় কেউ বয় দেখিয়ে সম্মতি আদায় করতে পারে, এতটা অবুঝ বয়সে আবাসিক কখনোই দেবেন না, তাও এই নষ্ট যুগে।

এবার কিয়াসে আসেন। আমি নিজের ছেলে সন্তানকে অবশ্যই আলিম বানাবো ইনশাআল্লাহ। দিলের তামান্না। সওয়াবে জারিয়া হবে। কিন্তু অবশ্যই বালেগ হওয়া বা ভালোমন্দ বুঝার মত বয়সের আগে আবাসিক মাদরাসায় দেবনা। বর্তমানে আমাদের প্রচলিত হিফজ সিস্টেম এক্সক্লুসিভলি আবাসিক। এখানেও ক্যাডেট কোচিং এর মত ৮-১৪ বছর বয়েসী বাচ্চারা আবাসিক থেকে পড়ে। আমার আগের বিশ্লেষণগুলো আমরা আবার স্মরণ করি ও মিলিয়ে দেখি:

১. যে ঘটনাগুলো আপনাআপনি বেরিয়ে আসে সেগুলো আমরা জানি।

২. আরও বহু ঘটনা বেরিয়ে আসে না, বা সম্মতিক্রমে হয়। সেগুলো আমরা জানি না।

৩. নাবুঝ বাচ্চাকে বয়সে বড় কেউ ভয়ভীতি দেখিয়ে ভিকটিম করতে পারে। মাদরাসার বেরিয়ে আসা ঘটনাগুলোতে আমরা পাই, বিকৃতমনা ওস্তাদ এভাবে ভয় দেখাচ্ছ: করতে না দিলে পড়া ভুলে যাবি/ কাউকে বলে দিলে আল্লাহ কঠিন আজাব দিবে/ কোনোদিন আলেম হতে পারবি না/ করতে না দিলে শরীরে খারাপ হয়ে যাবে, মারাত্মক সব অসুখ হবে। এই কথাগুলো ধরতে না পারার বয়সে কেন আপনারা বাচ্চাদের দেন?

৪. আর প্রলোভন দিয়ে বা একটা মানসিক বন্ধন তৈরি করে যে ঘটনাগুলো ঘটে সেগুলো আমি-আপনি কখনোই জানবো না। এমন হতে পারে ভিকটিম নিয়মিত গিফট, খাবার দাবার পায়। বা একটিভের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে যায়, ইমোশন তৈরি হয়। এমন বহু ঘটনা আছে, ভিকটিমরা জানিয়েছে। একটা ঘটনায় ভিকটিমকে একটিভের নামে ধর্ষণের অভিযোগ আনতে বলা হচ্ছিল। ভিকটিম বলল: কেন অভিযোগ করব, আমি ওকে ভালোবাসি। এই ঘটনাগুলোই বেশি। এগুলো আবাসিক শিশু প্রতিষ্ঠানে বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। খুবই অহরহ ঘটা ঘটনা।

৫. এরা বড় হয়ে নতুন কাউকে ভিকটিম বানাচ্ছে।

ঝেড়ে কাশি:

ক্যাডেট কলেজ, ভার্সিটি হল, বোর্ডিং স্কুল/কোচিং, ব্যারাকে বেশি হয়? নাকি মাদরাসাগুলোতে বেশি হয়? এই স্ট্যাটস ও পাওয়া অসম্ভব, সেই বিচার করতেও আমি বসিনি। ওসব জায়গায় সবাই সমকামী হয়ে গেলেও আমার কিচ্ছু যায় আসে না। কিন্তু মাদরাসায় বছরে একটা ঘটলেও আমার যায় আসে। কেননা, আমি আমার সন্তানকে ওসব জায়গায় দেব না। আমি আমার সন্তানকে আলিম বানাবো, সুতরাং আমি নিজের চরকাতেই আছি এখনও।

আমি কখনোই বিশ্বাস করি না, আমাদের উলামা হযরতগণ এই নাবালেগ ছেলেশিশুর ফিতনার ব্যাপারে জানেন না। এই ফিতনা যে নারীর ফিতনার চেয়ে খারাপ এটা তারা জানেন না, আমি বিশ্বাস করি না। আমি কখনোই বিশ্বাস করি না, প্রচলিত হিফজ সিস্টেমে নাবালেগ বাচ্চাদের সাথে যুবক উস্তাদের একসাথে থাকাটা নারী-পুরুষ একসাথে থাকার চেয়েও শয়তানের কাছে পছন্দনীয়, এটা তাঁরা জানেন না। তাঁরা অবশ্যই জানেন যে এভাবে নাবালেগ শিশুদের সাথে রাতযাপন শরীয়াসম্মত নয়। আমি কখনোই বিশ্বাস করি না, এই শরীয়াবিরোধী ফরমেট পরিবর্তন করে নতুন অনাবাসিক বা বালেগ হবার পরের নতুন ফরমেট আনার যোগ্যতা তাদের নেই। অবশ্যই তাঁরা যোগ্য, তাঁদের যোগ্যতা আছে নতুন ফরমেট আনার। তাহলে কেন তাঁরা করছেন না? এখানেই আমার কষ্ট। কথা উঠছে, ঘটনা ঘটছে, তাঁরাও জানেন এটা শরীয়াসম্মত না, পরিবর্তনের যোগ্যতা ও এখতিয়ারও তাঁদের আছে। এরপরও কেন হচ্ছে না? ছাত্র কমে যাবার ভয়? তাহলে কেন? আদীব হুজুরের ফরমেট কেন গ্রহণ করা হচ্ছে না? যদিও উলামায়ে কিরাম এসব ব্যাপারে যথেষ্ট সতর্ক অবস্থানে আছেন, বিশেষ করে বড় বড় মাদরাসাগুলোতে। কিন্তু মোড়ে মোড়ে হাফিজিয়া মাদরাসা এবং মফস্বলের মাদরাসাগুলো ঝুঁকিমুক্ত নয়। একজন ভবিষ্যত অভিভাবকের দৃষ্টিতে আমার কিছু প্রস্তাব আছে। ছোট মগজের চিন্তাগুলো পেশ করার গোস্তাকি মাপ করবেন।

  • আমি খুব সম্ভবত কিশোরগঞ্জেই হবে, এক বড় মাদরাসায় উস্তাযগণের যিয়ারতে যাই এশার পরে। তো, লম্বা রুমের এক পাশে একজন উস্তাযের বিছানা, বিছানা আর বাকি রুমের মাঝে উঁচু পর্দা। পর্দার ভিতরেই উস্তাযের সাথে আরেক ছাত্রের বিছানা ফ্লোরে। আমরা উস্তাযের সাথে কথাবার্তা বললাম, আর ঐ খাদেম ছাত্র আমাদের পানি-বিস্কুট দিয়ে আপ্যায়ন করল। আমার দেখে পছন্দ হল না, পর্দার এক পাশে ২০ জন ছাত্র, আর একপাশে উস্তায আর এক নাবালক খাদেম। কিন্তু দিলে দিলে ভালো ব্যাখ্যা করলাম, যুবক উস্তাযের ছেলে তো না, তবে হয়ত ভাগ্নে-ভাস্তে হবে। বড় বড় মাদারিস এমন পর্দা ব্যবহারের ব্যাপারে যথেষ্ট সতর্ক। কোন ধরনের পর্দা থাকবে না।
  • ছেলেদের উপর সতর্ক দৃষ্টি রাখতেই বোধহয় ছাত্রদের সাথেই উস্তায ঘুমান। আমার খেয়ালে, এক বয়সের বাচ্চাদের একসাথে রাখলে (মিক্সিং না) নজর রাখার প্রয়োজন কমে যাবে। উস্তাযদের থাকার জায়গা আলাদা হবে। রাতে উস্তাযের রুমে কোনো ছাত্র থাকবে না।
  • সব বয়সী ছাত্রকে এ বিষয়ে খোদ অধ্যক্ষ শিক্ষিত করবেন, যাতে তারা বিষয়ের গুরুত্ব বোঝে। যে কোন আপত্তিকর কিছু নজরে এলে, খোদ অধ্যক্ষকে এসে জানাবে।
  • মাদরাসায় স্কুলের মত টিসি (ট্রান্সফার সার্টিফিকেট) ব্যবস্থা থাকবে। এক মাদরাসায় ভর্তি হতে হলে আগের মাদরাসার টিসি লাগবে। কোন ছাত্র ধরা পড়লে পুরো মাদরাসার সব ছাত্রের সামনে তাকে রেডটিসি দেয়া হবে, যেন সবাই শিক্ষা নেয়। তার আর এলম হাসিলের দরকার নাই, সে জেনারেল লাইনে পড়ুক। আবাসিক থাকার যোগ্যতা সে হারিয়েছে। এ ব্যাপারে কোনো দয়ামায়া নেই। হদ কায়েম তো পারছেন না, এটুকু করতে দয়া দেখানো যাবে না।
  • উস্তাদ নিয়োগের সময় তাদের সার্টিফিকেটের কপি তো বোধ হয় রাখা হয় অফিসে। কোন উস্তায ধরা পড়লে তাৎক্ষণিক তার মাদরাসায় (সে যেখানে পড়েছে) যোগাযোগ করে সনদ কাটা হবে
  • ওস্তায নিয়োগের সময় তার মাদরাসায় খোঁজ নেয়া হবে, কোন রিপোর্ট আছে কি না। এই সিস্টেমে সমকামের রিপোর্ট আছে এমন লোক উস্তায হবার যোগ্যতা হারাবে। বহু পেশা আছে দুনিয়ায়, কেউ না খেয়ে মরে না।
  • কোন ওস্তায ধরা খেলে তাকে সাধারণত বহিষ্কারই করা হয়। তবে সবার সামনে এসেম্বলী ডেকে বহিষ্কার করা হবে। যাতে বহু সাক্ষী থাকে। নবীজী ব্যভিচার গোপন করার চেষ্টা করেছেন, এই দলিল সমকামের ক্ষেত্রে খাটে না। সমকাম অতিগর্হিত ও ঘৃণ্য কাজ, ফিকহে এর শাস্তিও দৃষ্টান্তমূলক। যেহেতু হদ কায়েম করতে পারছেন না, অন্তত এমন ব্যবস্থা নেন, যা সবার জন্য দৃষ্টান্ত হবে।
  • বিশেষ করে হিফজখানায় বিবাহিত উস্তাদ রাখা। তাঁদেরকে স্ত্রীসহ আবাসিক থাকার ব্যবস্থা থাকতে হবে। সম্ভব না হলে (অধিকাংশ মাদরাসায়ই সম্ভব হয় না) প্রতি পাক্ষিক বা মাসিক ২/৩ দিনের ছুটিতে স্ত্রীর কাছে পাঠানোর ব্যবস্থা থাকা চাই।
  • তাবলীগে মাস্তুরাতসহ জামাত (মহিলাসহ পুরুষের জামাত) সবচেয়ে সেনসিটিভ কাজ। কোন বাসায় জামাতের মহিলারা উঠবে কি না, বেপর্দা হবার সম্ভাবনা আছে কি না, কোন বাসা মহিলাদের সাপ্তাহিক তালিমের উপযোগী কি না, মোটকথা মহিলাদের প্রতিটি ইস্যুই প্রথমে স্থানীয় জিম্মাদাররা দেখে অনুমোদন দেন, কয়েকবার করে দেখেন। সব শর্ত পুরা হয়েছে কি না নিশ্চিত হয়ে এরপর অনুমোদন দেন। এখন আল্লাহর রহমতে মাদরাসা ও হিফজখানা সংখ্যায় অগণিত। আমার খেয়াল হয়, হাইয়া বা বেফাক কিংবা সংশ্লিষ্ট বোর্ডে একটা শৃঙ্খলা কমিটি থাকবে যারা মাদরাসা প্রতিষ্ঠার শর্ত গুলো যাচাই করে দেখবেন। তাদের গ্রীন সিগন্যাল পেলে মাদরাসা করা যাবে, নতুবা হবে না
কিছু বিষয় সবাই খেয়াল রাখবে:
  • দুজনকে বার বার একই বিছানায় পাওয়া যাচ্ছে। নিষেধ করলেও পাওয়া যাচ্ছে।
  • বিভিন্ন ছুতোয় দুজন একই সাথে বা একটু আগে পরে টয়লেটের নাম করে বাইরে যায় কি না
  • কোনো উস্তাদ কোনো ছাত্রকে অকারণে বার বার ভুল ধরে বা অকারণে শাস্তি দেয় কি না (চাপে ফেলার জন্য)
  • কোনো উস্তায কোনো ছাত্রকে অতিরিক্ত মুহাব্বত করে, বেশি বেশি হাদিয়া দেয়া (চোখে লাগার মত)।
  • পৃথক অভিযোগ বাক্স থাকবে। পরিচয় প্রকাশ না করেও অধ্যক্ষ বরাবর সমস্যা জানাতে পারবে।
  • প্রায় প্রায়ই এসকল বিষয়ে অধ্যক্ষ ছাত্রদের ও উস্তাযদের সতর্ক করবেন।
  • বাচ্চাদের মাঝে পৌরুষ গড়ে উঠছে কি না সে বিষয়েও দৃষ্টি রাখা। সাহাবীদের বীরত্ব ও সাহসের মুযাকারাগুলো তাদের মাঝে পুরুষালি রুক্ষতা ও মেজাজ তৈরিতে সহায়ক হবে।
  • আদীব হুজুরের হিফজ ফরমেটকে মূলধারায় কীভাবে নেয়া যায়, কিছু পরিবর্তন করেই নেয়া হোক। আর আমি যদি ভুল না হই, সৌদি আরবে তাহফীজই একটা তাখাসসুস। বিষয়টা আরও জেনে বিবেচনা যোগ্য।
অভিভাবকদের প্রতি আরজ:

পয়লা আপনাকে খুব গভীরভাবে বর্তমান যুগটাকে বুঝতে হবে। বাপমাদের সবচেয়ে বড় ভুল তারা এটা বুঝে না যে, তাদের ছেলেবেলা আর সন্তানদের ছেলেবেলা এক না। তাদের যুগ আর এই যুগ এক না। তারা মনে করে সবই এক। বর্তমান যুগ স্মার্ট ফোনের। পকেটের মধ্যে সব আছে। কেউ নষ্ট হতে হলে এখন তাকে পতিতালয়ে গিয়ে নষ্ট হতে হয় না, একটা স্মার্টফোন হলেই হয়। পর্নোগ্রাফির ছোবল থেকে কোন বয়সের মানুষই নিরাপদ নয়, মাদরাসাগুলোও নয়, উস্তাযগণও নয়। যেহেতু কেউ-ই ফেরেশতা নয়, সুতরাং যেকোন দুর্ঘটনা আমার-আপনার দ্বারাও ঘটতে পারে, এই আশঙ্কার নামই ঈমান। গুনাহের ব্যাপারে নির্ভীক হওয়া ঈমানের মজবুতির লক্ষণ না, মূর্খের লক্ষণ। আর গুনাহের ব্যাপারে সতর্ক থাকাই মজবুত ঈমানের লক্ষণ।

  • এত ছোট বাচ্চাকে আবাসিক দিবেন না, যে হালাল হারাম বোঝে না, যাকে সহজে একটা ভুল বুঝিয়ে ফেলা যায়। হাফেজ বানানোর চেয়ে বহু জরুরি তাকে গুনাহ থেকে বাঁচানো। ৮ বছরের আগে তো আবাসিক নয়ই। ‘করতে না দিলে পড়া ভুলে যাবি’ ‘বলে দিলে আল্লাহ আজাব দিবে’ জাতীয় কথা ধরার বয়স না হলে, নিজেকে রক্ষা করার মত বুঝ না হলে আপনারা এতটুকুন বাচ্চাকে কীভাবে ছাড়েন আমার বুঝে আসে না। অনেকে বলেন, ছোট বাচ্চাকে আবাসিক না রাখলে ‘ভালো হাফেজ’ হওয়া যায় না। আচ্ছা, ভালো হাফেজ কেন হতে হবে? এটা কি ক্যারিয়ার? হিফজ করার পর তিলওয়াত করতে করতে, তারাবীহ পড়াতে পড়াতে, লোকমা খেতে খেতে ভালো হাফেজ হবে। এটাতো ক্যারিয়ার না, যে ভালো হাফেজ বের করতে হবে। যেসব হাদিসে সন্তানের কুরআন হিফজ করানোর ফাযায়েল আছে, কোথাও নেই যে আপনার সন্তানকে ভালো হাফেজ বানাতে হবে, যাতে ভালো জায়গায় তারাবী পায়, কোনো লোকমা ছাড়া ভাল জায়গায় পড়াতে পারে, আন্তর্জাতিক পুরস্কার এনে দিতে পারে।
  • আপনাদের চাহিদা সাপেক্ষে সমাজে সেবার ধরন নির্ধারিত হবে। আদীব হুজুরের হিফজ ফরমেটটা সবাই জেনে রাখেন। কোন ভাইয়ের কাছে লিংক থাকলে দিয়েন। আগে ২/৩ বছরে উনার লিখিত ‘এসো আরবি শিখি’ বইটা শেষ করানো হয়। আরবি ভাষা জানা থাকায় হিফজ হয় দ্রুত। নর্মাল সিস্টেমে যেখানে ২-৩ বছর লাগে, সেখানে আদীব হুজুরের ফরমেটে লাগে ৬মাস থেকে দেড় বছর। এটা মূল সিস্টেম হওয়া এখন সময়ের দাবি।
  • মাদরাসায় দিয়েই দায়িত্বমুক্ত হবেন না। মাদরাসায় বাচ্চা কী করে খোঁজখবর নেন। উস্তাদদের সাথে বসেন। বাচ্চার বন্ধুদের সাথে গল্প করেন। মাদরাসায় দিয়েছি, সন্তান ফেরেশতা হয়ে বের হয়ে আসবে, সে যুগ এখন আর নাই।
  • সন্তান মাদরাসায় যেতে না চাইলে, কেন যেতে চায় না শোনেন। বের করেন। প্রয়োজনে মাদরাসা বদলান। জোর করে পাঠাবেন না।
  • বাচ্চাকে দিয়ে ঠেকে যাননি। অধ্যক্ষের সাথে দেখা করে অভিভাবক হিসেবে মতামত দিন।
  • বাচ্চাকেও কিছু শিক্ষা দিন। ইঙ্গিতে বিষয়গুলো আগেই নলেজে দিন। তার সাথে খারাপ কিছুর আভাসে সে যেন গোপন না রাখে।
  • সম্ভব হলে বালেগ হওয়া পর্যন্ত, পুরুষালি ভাব আসা অব্দি অনাবাসিক পড়ান
  • বাসায় সুন্নাহসম্মত পরিবেশ বানান। টিভি বের করে দেন, বদদীনী সামান বের করে দেন। ঘরের দীনী পরিবেশ তৈরি করেন।
  • আরও ভালো হয়, নিজে ৬-৯ বছর পর্যন্ত পড়ানোর মত অনলাইন মাদরাসায় বা বয়স্ক মাদরাসায় কিছু দীনী পড়াশোনা করেন। নূরানী কোর্স করে ফেলেন। উলামা হযরতগণ আমাদের জন্য ‘হোম স্কুলিং সনদ কোর্স’ খুলতে পারেন।
  • উলামাগণ কর্তৃক অনুমোদিত হোমস্কুলিং ফরমেট আসা সময়ের দাবি। হোমস্কুলিং সনদপ্রাপ্ত পিতামাতা বাচ্চাকে একটা বয়স পর্যন্ত বাসায়ই পড়াবে। এরপর মাদরাসা একটা পরীক্ষা নিয়ে তাদেরকে ভর্তি করে নেবে।
  • মক্কার উম্মুল কুরা ভার্সিটির প্রফেসর আবদুর রহমান সাহেব আমাকে জানিয়েছেন, উনি যখন কানাডা ছিলেন, উনার নিজ সন্তানসহ বিবিসাহেবার কাছে বিভিন্ন দেশের বহু মুসলিম সন্তান হিফজ করেছে। তার মানে ঘরেও হিফজ সম্ভব। পরিবারে একজন হাফেজ (পুরুষ/মহিলা) থাকলে বাসায়ই সম্ভব। আকাবিরীনরা অধিকাংশই বাসায়ই হিফজ করেছেন।
  • পিতা সন্তানকে সময় দেন। নিজের মত পুরুষালি বানান। সে যেন বাবার মত হবার স্বপ্ন দেখে।
  • মেয়েদের ব্যাপারে আরও সতর্ক হতে হবে। মেয়েদের শিক্ষা পুরোটাই হোমস্কুলিং এ নিয়ে আসতে হবে। সনদপ্রাপ্ত পিতামাতা হোমস্কুলিং করে মাদরাসা একটা পরীক্ষা নেবে। চাচা ভাতিজীকে মেশকাতের ইজাজাহ দিল, মামা/ভাই পড়ালো। সন্তানদের পড়ানোটাকে একটা কাজ বানান। মায়ের চোখের বাইরে একটা মেয়েশিশু তো এখন খোদ বাবার কাছেও নিরাপদ না, অন্যভাবে নিয়েন না। এটাই বর্তমান যুগবাস্তবতা। কষ্ট হলেও মেনে নিতে হবে। আল্লাহ সহজ করুন। আমাদের ঈমান-আমল-আওলাদ হিফাজত করুন। মেয়ে বাচ্চাকে গায়ে হাত তুলে মারবেন না। একটু বড় হয়ে গেলে ছোটবেলার মত আদর করবেন না। এক ঘরে অবস্থান করবেন না। মায়ের চোখের আড়াল যেন না হয়, আবাসিক মাদরাসায় দেয়া তো দূর কি বাত।
  • নিজেদের হোমস্কুলিং এর জন্য গড়ে তোলা ছাড়া অভিভাবকদের সামনে আর উপায় নেই। সত্যিই নেই। সামনের দিনগুলোতে আমার এই কথার বাস্তবতা আরও স্পষ্ট হবে।

* * *

সেবাগ্রহীতাদের চাহিদার উপর ভিত্তি করে সেবার কৌশল পরিবর্তন হয়। আপনারা অনাবাসিকে আগ্রহ দেখালে, অনাবাসিক প্রতিষ্ঠান গড়তে থাকবে। বালেগ হবার আগে ছেলেশিশুদের মাঝে নারী-সিফত থাকে। চপলতা, চিকন কণ্ঠ, কমনীয়তা, ত্বকের মসৃণতা। বিকৃতমনা বা বয়ঃসন্ধিতে আগেই পৌঁছানে আরেক বালক (যে কিনা নারীসিফতগুলোর প্রতি আকর্ষণ বুঝছে), সে নারীর অবর্তমানে বাচ্চার ঐ সিফতে আকৃষ্ট হতে পারে। আমরা আপনার সন্তানও হতে পারে বিকৃতির ভিকটিম। সেটা প্রকাশ পেতে পারে, আবার গোপনও রয়ে যেতে পারে। সেটা আর উঠে আসবে না। আপনি হয়ে যেতে পারেন অভ্যস্ত সমকামীর পিতা। যুগকে বুঝুন, যুগের প্রভাবকে বুঝুন। এটা পীর-মাশায়েখের যুগ না, এটা পর্নোগ্রাফি আর সাতরঙের যুগ।

এটা পীর-মাশায়েখের যুগ না, এটা পর্নোগ্রাফি আর সাতরঙের যুগ।

এটা পীর-মাশায়েখের যুগ না, এটা পর্নোগ্রাফি আর সাতরঙের যুগ।

এটা পীর-মাশায়েখের যুগ না, এটা পর্নোগ্রাফি আর সাতরঙের যুগ।

এটা না লিখে ফেসবুক ছেড়ে গেলে অপরাধী হয়ে যেতাম নিজের কাছে। এ থেকে বাঁচতে কী করণীয়, উলামায়ে কেরাম জানেন। আল্লাহ আমাদের সন্তানদের হিফাজত করুন।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *