সম্মতি রম্য: পর্ব ১


লিবারেল মানদণ্ডে ‘সম্মতি’-ই হল বৈধ-অবৈধের মাপকাঠি। সম্মতি থাকলে তাদের হিসেবে ব্যভিচার, সমকাম, শিশুকাম, পশুকাম ইত্যাদি বৈধ। যেমন:

পশ্চিমা যৌন বিজ্ঞানের পুরোধা John Money, Ph.D. ডাচ শিশুকাম জার্নাল PAIDIKA-তে সাক্ষাৎকার দেন : বয়স্ক পুরুষ আর ছোট বালকের যৌন সহবাস গঠনমূলক হতে পারে, যদি উভয়ের সম্মতি থাকে।

https://www.josephnicolosi.com/collection/psych-association-loses-credibility-say-insiders

সেক্সোলজিস্ট Hani Miletski দাবি করেছেন : এমনকি জন্তুরাও যৌনসম্মতি দানে সক্ষম, তাদের নিজেদের মতো করে (Miltski, 1999)। যেমন কুকুররা লেজ নাড়ে। মালিক বুঝতে পারে তার সম্মতির ইশারা।

দুজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ, বা একজন মানুষ একজন পশু পারস্পরিক সম্মতিতে কারও ক্ষতি না করে যা ইচ্ছে তাই করতে পারবে। আর সম্মতি না থাকলে বৈধ সম্পর্কের দাবিও হয়ে যাবে অবৈধ। আমরা একটু দেখব ‘সম্মতির ইতিহাস এবং গতিদিক। সম্মতির এই মানদণ্ড ধ্রুব কি না, পুরো দুনিয়া মানতে বাধ্য কি না সেটা আগে আলোচনা করে নেয়া প্রয়োজন।

সম্মতি

বর্তমান পাশ্চাত্য সভ্যতা নিজেকে ক্ল্যাসিকাল গ্রেকো-রোমান সভ্যতার উত্তরাধিকারী মনে করে। পূর্ববর্তী আলাপে আমরা দেখেছি, কীভাবে মধ্যবর্তী ব্যবসায়ী শ্রেণীর হাত ধরে এসেছে ফরাসী বিপ্লব। মধ্যযুগীয় আর্থসামাজিক কাঠামো (রাজতন্ত্র+সামন্ততন্ত্র+যাজকতন্ত্র+ধর্মীয় নীতিবোধ) উচ্ছেদ হয়ে ব্যবসায়ী শ্রেণীর আধিপত্য বজায় থাকে এমন কাঠামো গৃহীত হয়েছে (গণতন্ত্র+লিবারেল সমাজ+ধর্মনিরপেক্ষতা+লিবারেলনৈতিকতা+পুঁজিবাদ)। সমাজের গোষ্ঠীগত স্তরবিন্যাস (hierarchy) অবসান হয়েছে, যেটা আগে মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করত। এখন এই নিয়ন্ত্রক ভেঙেচুরে দিয়ে বলা হয়েছে: প্রত্যেকে স্বাধীন ও সমান। এই লক্ষ লক্ষ সমান ও স্বাধীন (masterless) মানুষকে এখন কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হবে? এরই সমাধান দিতে আনা হল উদারনৈতিকতা বা লিবারেলিজমকে। সমাধানটা হল:

  1. প্রত্যেকে নিজের ভিন্ন ভিন্ন ভূমিকাকে ভিন্ন ভিন্নই রাখবে। ধর্মকে বাদবাকি জীবন থেকে আলাদা রাখবেন। মসজিদের আপনি আর অফিসের আপনি হবেন আলাদা।
  2. সম্মতি।

রোমান আইন অনুসারে volenti non fit injuria (to a willing person, no injury is done.); যে কাজ ভিকটিমের সম্মতি নিয়ে করা হয়, তা ক্ষতি না। সুতরাং যেহেতু তা কারও ক্ষতি করছে না, সুতরাং তা আইনত অপরাধ না; নৈতিকভাবে মন্দ না, অবৈধ না। সুতরাং সম্মতি-ই এই masterless ধর্মহীন মানুষদের পারস্পরিক ইন্টার‍্যাকশানের সীমারেখা। তাই কি? যেখানে সম্মতি আছে, সেখানে ক্ষতি নেই? সম্মতি নেই, আবার ক্ষতিও নেই এমন অনেক ক্ষেত্রও তো রয়েছে। চলুন দেখা যাক।

সম্মতি আছে, কিন্তু ক্ষতি আছে

সম্মতির সাথে সমকাম: টিকা দেয়া সমকামীদের মধ্য থেকে প্রতি বছর ৪০ হাজার নতুন এইডস রোগী তৈরি করছে। তারা নিজে আক্রান্ত হচ্ছে, অন্যদের আক্রান্ত করছেএছাড়া আরো বহু বহু অসুখ-বিসুখ ছড়াচ্ছে তারা। কোনোভাবেই ঠেকানো যাচ্ছে না।

সম্মতির মাধ্যমে LGBT : নিজেদের যারা LGBT দাবি করে, সেসব তরুণ-তরুণীদের মাঝে—

  • high risk sexual behaviors-এ অংশ নেওয়া
  • early age for sexual initiation
  • high numbers of sexual partners
  • exchanging sex for goods
  • unprotected sexual activity-তে লিপ্ত হতে দেখা যায় (been found) (Rosario, et al., 1999).

সম্মতির সাথে মাদকসেবন: মাদকের থাবায় ৩১ কোটি ২০ লক্ষ মানুষ ধুঁকছে । মাদকাসক্তকে জোর করে দেয়া হয় না। সে নিজেই স্বেচ্ছায় নেয়।

সম্মতির ভিত্তিতে যে ব্যভিচার বা লিভটুগেদার কালচার, তার ফলে :

  • ব্যভিচারের কারণে ৪০% বিবাহিত পরিবার ভেঙে যাচ্ছে। রিসার্চ জানাচ্ছে, মোট ডিভোর্সীর ৪২%-এরই বিয়ে থাকা অবস্থায় ব্যভিচারের ইতিহাস আছে (Janus, 1993)। এজন্যই আমেরিকার ৫০% ১ম বিয়ে বিচ্ছেদে পর্যবসিত হয় (Bramlett & Mosher, 2001)।
  • আর ব্যভিচারের ভিত্তিতে গঠিত লিভ-টুগেদার পরিবারের ৬৫%-ই ভেঙে যাচ্ছে। (Osborne, 2007)।

তাহলে এই পরিবারগুলোর যে সন্তানরা, তাদের শারীরিক মানসিক বিকাশে ক্ষতি হচ্ছে, নাকি হচ্ছে না?

সম্মতি থাকলেই সেখানে শারীরিক-মানসিক-সামাজিক ক্ষতি নেই; পুরোপুরি ভুল। এই ভুল নৈতিকতা কীভাবে জোর করে চাপানো যায় পুরো দুনিয়ায়?


সম্মতি নেই, কিন্তু ক্ষতি নেই

  • মৃত লাশের সাথে সঙ্গম। এখানে কারও কোনো ক্ষতি হচ্ছে না। কিন্তু কল্যাণ অর্জন হচ্ছে, সুখ হচ্ছে।
  • মেয়েদের বাথরুমের ভিডিও চেহারা ব্লার করে ছড়িয়ে দেয়া মেয়েদেরও ক্ষতি হল না, ওদিকে বহু দর্শকামীর (voyeurism) সুখ লাভ হচ্ছে।
  • বাজার থেকে মৃত মুরগী কিনে এনে সেক্স করা। কারও ক্ষতি না করেই সুখ লাভ হচ্ছে।

তাহলে পাঠক বুঝা যাচ্ছে যে, এই ‘সম্মতি’র স্কেলটা ধ্রুবসত্য না বা প্রশ্নের ঊর্ধ্বে না। যেভাবে একে মহাপবিত্র ও অলঙ্ঘনীয় বলে উপস্থাপন করা হচ্ছে তা মোটেই যৌক্তিক নয়। সম্মতি থাকলেও কোনো কাজ ক্ষতিকর হতে পারে, সুতরাং অবৈধ সাব্যস্ত করা যেতে পারে। আবার সম্মতি নেই এমন কোনো কাজেও সর্বোচ্চ সুখ অর্জিত হতে পারে কারও বিন্দুমাত্র ক্ষতি না করে।

Yale University-র জেন্ডার স্টাডিজের প্রোফেসর Joseph Fischel বলছেন:


সম্মতি ব্যাপারটাই Flimsy (যুক্তিহীন, দৃঢ়তাহীন, লগবগে)। ‘যৌনতার ক্ষেত্রে ন্যায়-নির্ণয়’-এর যে দায়িত্ব আইন বা সমাজ একে দিয়েছে, তা সব এ পালন করতে পারে না। আইনগতভাবে সম্মতিভিত্তিক সম্পর্কের ভিতরেও এমন মিলন হতে পারে যা ক্ষতিকর, তিক্ত কিংবা অপরাধবোধে জর্জরিত। আবার আইনত সম্মতিহীন যৌনসম্পর্কেও এমন মিলন হতে পারে, যা ফর্মেটিভ (ব্যক্তিত্ব গঠন করে), ট্রান্সফর্মেটিভ (ব্যক্তিত্ব বদলে দেয়), ভাল, দারুণ, ওকে কিংবা একেবারেই সমস্যাজনক না। যেমন: দু’জন অপ্রাপ্তবয়স্ক, বা প্রাপ্তবয়স্ক-অপ্রাপ্তবয়স্ক মিলন।

যদিও এখন আওয়াজ তোলা হচ্ছে ‘consent is sexy’, বাস্তবে গিয়ে যৌনভাবপ্রকাশ, ভুলবার্তা দেয়া কিংবা নিজেদের ব্যাপারে সঙ্গীর কাছে সত্যগোপন‑ এসব ক্ষেত্রে সম্মতি তেমন কাজের জিনিস না। সম্মতি-র কেবল পাল্লাই সীমিত তা না, এটা যথেষ্টও না, প্রয়োগযোগ্যতাও কম। … সেদিন এক ডানপন্থী উপস্থাপক বলছিল: #MeToo আন্দোলনের একটা অংশ বাজে সেক্স আর ধর্ষণকে গুলিয়ে ফেলেছে। অথচ ধর্ষণ ছাড়াও বাজে যৌন অভিজ্ঞতা হতে পারে। এগুলো মূলত sexual politics.

Joseph Fischel, Sex and Harm in the Age of Consent, p10 associate professor of women’s, gender and sexuality studies at Yale University.
যৌনসম্মতি জিনিসটা তো অত্যন্ত অস্পষ্ট ও ধোঁয়াশাময়


বিশেষ করে যৌনসম্মতি জিনিসটা তো অত্যন্ত অস্পষ্ট ও ধোঁয়াশাময়। শুনুন কানাডার ইয়র্ক ইউনিভার্সিটির আইনের অধ্যাপক Heidi Matthews-এর মুখে:

মনে হয়, আমরা ‘সম্মতি’র যুগে বাস করছি। সামাজিকভাবে কাম্য এবং আইনত বৈধ সেক্স কাকে বলা হবে, তার মাপকাঠি হওয়া উচিত ‘সম্মতি’ – এই ধারণাটা বাস্তবতা থেকে বহুদূরে। কারণ সেক্স কী জিনিস, এটা ভিন্ন ভিন্ন সময় ভিন্ন ভিন্ন অর্থ দেয়। নারীবাদীরাও স্বীকার করে যে, সম্মতি থাকলে যৌনকামনা আছে, সম্মতি নাই মানে যৌনকামনা নাই—চিন্তাটা বাস্তব না।

একটা সেক্স সেশনের ভিতরে-বাইরে সম্মতির ব্যাপারটা খুবই জটিল ও আগে থেকে বলা যায় না (শুরুতে প্রকাশ না পেলেও সেক্সের মাঝে সম্মতি তৈরি হতে পারে)একই সেক্স সেশনে ভিন্ন ভিন্ন অনুভূতিও হতে পারে: ‘অপমানজনক তবে উত্তেজনাকর’ মনে হতে পারে। কখনও বিরক্তিকর কখনও তৃপ্তিদায়ক মনে হতে পারে। কখনও ভীতিকর কিন্তু ‘বার বার করতে ইচ্ছে করছে’ এমন মনে হতে পারে। আরও যদি বলি, সম্মতির সেক্স মানেই আমি এখন চাচ্ছি, তা না। আবার অসম্মতির সেক্স মানেই আমি চাচ্ছি না, তা-ও না। (What is more, consensual sex is not the same thing as wanted sex; conversely, non-consensual sex is not the same as unwanted sex.)

পুরুষের চেয়ে নারীর যৌন-আনন্দকে প্রায়ই বেশ জটিল ও কম অনুমানযোগ্য বলে মনে করা হয়। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া এটাই নিয়মের মত যে, নারী কী চায়, এবং কীভাবে সেই চাওয়াটা প্রকাশ করা উচিত, এটা তার নিজের কাছেই অস্পষ্ট থাকে। কখনও কখনও আমরা কী চাই, তা আগেই বুঝা যায় না। কামনা ও তৃপ্তির বিস্তারিত ব্যাপারটা প্রায়ই সেক্স চলমান সময়ে আবিষ্কৃত হয় বা তৈরি করে নিতে হয়। সম্মতি-ইচ্ছার মাধ্যমে প্রকাশের চেয়ে দুজনের যৌন-আচরণের ভিতর দিয়েই বরং স্বাধীনতাটা প্রকাশ পায়।

একটা সেক্স অপরাধ নাকি অপরাধ না, এই পার্থক্য করতে সম্মতি-র ধারণাটা আইন ব্যবহার করে। কিন্তু আমরা কীভাবে জানবো যে, সম্মতি আছে নাকি নেই? অনুমতি আছে নাকি নাই, এই দু’য়ের মাঝে যে দোলাচল (Liminal trust) সেখানে উভয়েই যৌনতার সবচেয়ে নির্ভুল উপলব্ধিটা পেতে পারে।

Heidi Matthews (6 March 2018) Aeon

এরকম একটা ত্রুটিপূর্ণ স্কেলকে নৈতিকতার মাপকাঠি ধরে আরেকজনের নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন কীভাবে যৌক্তিক?

বই : যুদ্ধ, মনস্তত্ব ও দক্ষিণহস্ত মালিকানা । শুদ্ধি প্রকাশনী


Leave a Reply