বইটি নিয়ে কথা কেন বলা প্রয়োজন:
প্রথম যখন দীনের বুঝ এলো, শুরুতে যে বইগুলো পড়ার সাজেশন পেয়েছিলাম, এটি তার মাঝে একটি। এবং খুব জোর দিয়ে বইটি পাঠের পরামর্শ আমাকে দেয়া হয়েছিল। ‘সালাফি দাওয়াহ’ ছাড়া অন্যান্য দাওয়াহর মাধ্যমে যারা দীনের পথে আসেন, তারা অনেকেই বইটি পড়ে থাকেন। শুধু পড়ে থাকেন তা-ই না, বরং সত্য নির্ভরযোগ্য এক দলিল হিসেবে বিবেচনা করে থাকেন এবং সোৎসাহে অন্যকে পড়বার সাজেশনও দিয়ে থাকেন। যেন এটা না পড়লে কী না কী মিস হয়ে যাবে, ইহুদি-খৃষ্টানদের ষড়যন্ত্র সম্পর্কে বেখবরই রয়ে যাবো, বাতিলকে চিনতে পারবো না ইত্যাদি।
বইয়ের উৎস?
একটা গ্রন্থের উৎস থাকে। অরিজিনাল ডায়েরিটা কোথায়, স্বাভাবিকভাবেই এই প্রশ্নটা চলে আসে। জন্ম দেয় আরো কিছু প্রশ্নের। জবাব হিসেবে বাংলা অনুবাদক লিখেছেন, ২য় বিশ্বযুদ্ধের সময় (১৯৩৯-১৯৪৫) জার্মানরা ডায়েরিটা হাতে পায় এবং জার্মান ভাষায় ধারাবাহিকভাবে Spiegel পত্রিকায় প্রকাশিত হতে থাকে। এর প্রমাণ পাওয়া যায় না। তাও সই, ‘মুসলিমদের নিয়ে বৃটিশ চক্রান্ত’ জার্মান ভাষায় ফাঁস না হয়ে ইংরেজি ডায়রি ইংরেজিতে ফাঁস হওয়াই বেশি ফলপ্রসূ ছিল নাৎসীদের স্বার্থে। সারা দুনিয়ার কাছে (বিশেষ করে উপনিবেশ-শাসিত মুসলিমদের কাছে) বৃটিশদের খারাপ করাই যদি উদ্দেশ্য হবে, তাহলে জার্মান ভাষায় কেন ইংরেজি ডায়েরি?
এবং মূল ইংরেজি ডায়েরিটা অদ্যাবধি কোথাও মেলেনি। বলা হচ্ছে ‘গোপন ডায়েরি’। যদি গোপনই হবে, তাহলে ২য় বিশ্বযুদ্ধের আগে আর কোথাও এইসব তথ্য প্রকাশ হবার কথা না। অথচ তুর্কী নৌবাহিনী অফিসার Ayyub Sabri Pasha-এর ১৮৮৪ সালে লেখা Mir’at al-Haramain (৫ খণ্ডে Matba’a-i Bahriyye, Istanbul থেকে প্রকাশিত) এ হুবহু একই ঘটনা কীভাবে এলো? বইয়ের The Beginning and Spread of Wahhabism অধ্যায়ে Sabri Pasha উল্লেখ করেছেন ইবনে আবদুল ওয়াহহাব (শাইখ নজদী) ও হেমফারের ষড়যন্ত্র। স্বাভাবিকভাবেই চিন্তা আসে, ইংরেজি ডায়েরি… প্রকাশ হচ্ছে তুর্কীতে, এরপর জার্মানে। মূল ইংরেজিটা কই? ইন্টারনেটে যত ফ্রী পিডিএফ পাবেন ইংরেজিতে, সবগুলোই তুরস্কের Hakikat Kitabevi প্রকাশনার। এছাড়া ছাপিয়েছে ইরানের কুম শহরের Ansariyan Publications. এবং আয়ারল্যান্ডের Omnia Veritas Ltd. কেন এরা কোনো উৎস না খুঁজেই বইটা ছাপিয়ে দিল, সে হিসাব-কিতাবে পরে আসা যাবে। Harvard’s Olin Institute for Strategic Studies এর প্রোফেসর প্রাচ্য-গবেষক Bernard Haykel বলেছেন, এটা ওয়াহাবী-বিরোধী একটি বানোয়াট ঘটনা, সম্ভব Ayyub Sabri Pasha-ই কাজটা করেছে। যেহেতু তার আগে আর কোনো উৎস পাওয়া যায় না। আমেরিকান ইতিহাসবিদ ও Middle East Forum-এর সভাপতি Daniel Pipes-এর মতে, এটা এক্কেবারে নিরর্থক।
যদিও এদেরকেও আমরা সন্দেহ করি, তবুও যার ভিত্তি নেই, তা গ্রহণ করতে ইসলাম আমাদের শেখায় না। আমাদের দীনকে উলামাগণ এমনভাবে আল্লাহর ইচ্ছায় হেফাজত করেছেন যে, প্রতিটি হাদিস, প্রতিটি ইতিহাস, এমনকি ‘অলৌকিক কারামত’ও আমরা ভিত্তি ছাড়া , সনদ ছাড়া বিশ্বাস করি না। কুরআনে আল্লাহ বলেছেন, ফাসেকের কথায় মুসলিমকে অপরাধী সাব্যস্ত না করতে। সেখানে এখানে তো কাফেরের কথায় মুসলিমকে অপরাধী সাব্যস্ত করার বিষয়ে আরও বেশি আরও স্পষ্ট প্রমাণ আমাদের প্রয়োজন। এবার আমরা বইয়ের ভেতরে প্রবেশ করছি।
১ম পয়েন্ট
- এই ঘটনার জনক Sabri Pasha-র মতে শাইখ নজদীর জন্ম ১৬৯৯ সালে, এটাই ধরব আমরা। তাঁর অন্যান্য জীবনীতে এসেছে জন্মসাল ১৭০২-১৭০৪। মনে রাইখেন এটুকু।
- হেমফার ইস্তাম্বুলে আসে ১৭১০ সালে, (নজদীর বয়স ১১) সে নিজেই উল্লেখ করেছে।
- ২ বছর ইস্তাম্বুলে থেকে চলে যায় লন্ডনে (১৭১২)- বিয়ে করে ৬ মাস লন্ডনে থাকে। ৬ মাস পর ইরাকের বসরা শহরে প্রবেশ করলাম (১৭১৩)। নজদীর বয়স ১৪ বছর, অন্যান্য সোর্স হিসেবে ১১ বছর। হেমফার আবার লন্ডনে ফিরে যায় ৩ বছর পর (১৭১৬) বলে সে উল্লেখ করেছে। তখন নজদীর বয়স ১৭ বা ১৪।
দেখেন ১৪ বছরের এক বালক সম্পর্কে হেমফার কী বলছে প্রথম দেখার পর—- তিনি তুর্কী, আরবি, ফার্সি জানতেন (১৪ বছর বয়সে! আহিলের ছেলেবেলা)
- ওসমানী সরকারের ব্যাপারে ভীষণ ক্ষিপ্ত!
- স্বাধীনচেতা যুবক।
- কিতাব-সুন্নাহ বুঝার ক্ষেত্রে নিজের উদ্ভাবনের উপর গুরুত্ব দিতেন! (১৪ বছরের বালক!!!!)
- এক শিয়া আলেমের সাথে ১৪ বছরের বালকের কঠিন বিতর্ক। (বাপরে বাপ!!)
এরপর সাফিয়া নামক এক খৃষ্টান নারী গোয়েন্দার সাথে তাকে মুতা বিয়ে করিয়েছে (১৪-১৭ বছর বয়সের ছেলে নজদীর সাথে)। সেই মেয়ে তাকে মদ খাইয়েছে। আরেকটা নারী ইহুদি আসিয়ার সাথে মুতা করিয়েছে। হেমফারের মতে, ১৭৩০ সালে নজদী তার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেন এবং দাওয়াহ শুরু করেন। তখন তাঁর বয়স ৩১ বা ২৮ বছর।
শাইখ নজদীর প্রথম দিককার জীবনীকার হলেন মালিকী আলিম Hussain ibn Ghannaam (মৃত্যু ১৮১০ সাল), নজদীর মৃত্যু ১৭৯২ । মানে মাত্র তাঁর মৃত্যুর ১৮ বছরের মাঝেই লেখা জীবনী। তিনি Tareekh Najd গ্রন্থে বলছেন, ১০ বছর বয়সে নজদী হাফেজ হন। ১২ বছর বয়সে বালেগ হবার পর পিতা তাঁকে ইমাম হিসেবে নিয়োগ দেন। ১২ বছর বয়সেই তাকে বিয়ে দেন এবং হজ্জে পাঠান। ১৭২২ সালের আগে (২০ বা ২৩ বছর বয়স) তিনি নজদ ত্যাগ করেননি । কোনটা স্বাভাবিক মনে হচ্ছে? ১০/১৪ বছরের বালকের ৭৯৩ কিলো দূরে শিক্ষার জন্য গমন, নাকি ২৩ বছরের যুবকের শিক্ষার সফর? হেমফারের ডায়েরির খণ্ডনে এসব তথ্য আনা হয়েছে, তা না। হেমফারের কথা মানুষ জেনেছে ১৮৮৪ সালে, আর এই জীবনী লেখা হয়েছে ১৮১০ সালের আগে।
২য় পয়েন্ট
দ্বিতীয়ত, হেমফার ১৭১০ সালে তার ডায়েরি শুরুই করেছে এভাবে:
Our Great Britain is very vast. The sun rises over its seas, and sets, again, below its seas. Yet our state is relatively weak concerning its colonies in India, China and Middle East. These countries are not entirely under our domination…(আমাদের মহান বৃটেন অত্যন্ত বিশালাকায়। সূর্য ওঠেও এর সাগরের উপর, ডুবেও যায় বৃটেনেরই সাগরে। তারপরও ভারত, চীন ও মধ্যপ্রাচ্যের উপনিবেশগুলোতে আমরা বেশ দুর্বল। দেশগুলো পুরোপুরি আমাদের অধীনে না…)
নিঃসন্দেহে ১৭১০ সালে বৃটিশ সাম্রাজ্য এতো বড় ছিল না। বিশেষ করে চীনে তো প্রশ্নই আসে না। ১৭৫০ সালে বৃটিশ কলোনীগুলোর একটা ছবি দিলাম।
<image1>
চীনের খবরই নেই, ১৮৩৯ সালে ১ম আফিম যুদ্ধের আগে চীনে বৃটিশ কলোনী স্থাপন হয়নি, কিছু ট্রেড ওয়্যারহাউস ছিলো। ১৭০৭ সালের একটা ম্যাপ দেখেন, তখনকার বৃটিশ সাম্রাজ্যকে কি একথা বলা যায় যে, সূর্য ওঠে আর ডোবে আমাদের সাগরে?
<image2>
আর মিডল ইস্টে তো বৃটিশ কলোনি ১ম হলোই ১৮৮২ সালে মিশরে। এর আগে মধ্যপ্রাচ্যে কোনো বৃটিশ কলোনী ছিলো না। যেহেতু এখানে মধ্যপ্রাচ্যে বৃটিশ কলোনীর কথা বলা হয়েছে, সুতরাং আরও বেশি সম্ভাবনা যে এটা ১৮৮৪ সালে Sabri Pasha-রই কাঁচা হাতের কাজ।
উপনিবেশী শক্তি হিসেবে এবং ক্রুসেডের প্রতিশোধের জন্য বৃটেন চাইতেই পারে ইসলামী সভ্যতাকে পরাজিত করতে। সেজন্য ভিত্তিহীনভাবে একজন আলিমকে কাঠগড়ায় তুলে দেয়াটা কতটা যৌক্তিক? হতে পারে তার সব সংস্কারের সাথে আমরা একমত নই। কিন্তু তাঁর ডাক তো কুরআন-সুন্নাহর দিকে ফেরার ডাক। নবিজির এসব হাদিস তো মিথ্যা না:
জাবির (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কবরের উপর চুনা লাগানো, তার উপর বসা, কবরের উপর গৃহনির্মাণ বা পাকা করতে নিষেধ করেছেন।
মুসলিম ৯৭০; তিরমিযী ১০৫২, নাসায়ী ২০২৭, ২০২৮, ২০২৯; আবূ দাউদ ৩২২৫, আহমাদ ১৩৭৩৫, ১৪১৫৫, ১৪২৩৭
‘ইয়াহুদী ও নাসারাদের ওপর আল্লাহর লানত। তাঁরা তাদের নাবীগণের কবরগুলোকে মসজিদ বানিয়ে রেখেছে’। তাঁরা যা করেছে তা থেকে নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুসলমানদের সতর্ক করেছেন।
সহীহ বুখারী (ইফাঃ), অধ্যায়ঃ ৮/ সালাত (كتاب الصلاة), হাদিস নম্বরঃ ৪১৫
‘আলী (রাযিঃ) বলেন, আমি কি তোমাকে এমনভাবে পাঠাব না, যে কাজে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে পাঠিয়েছিলেন? তা হচ্ছে কোন (জীবের) প্রতিকৃতি বা ছবি দেখলে তা চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিবে এবং কোন উঁচু কবর দেখলে তা ভেঙ্গে দিবে।
সহীহ মুসলিম (ইফাঃ), অধ্যায়ঃ ১২/ জানাযা সম্পর্কিত, হাদিস নম্বরঃ ২১১৭
যার ডাকে নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুর, যার ডাকে আলী রা. এর সুর— তার এই ডাকের জন্য ‘আশেকে রাসূল’গণ আর ‘আশেকে আলী’ গণই শাইখ নজদীকে হেয় করছে। কাফেরের কথায় (তাও প্রমাণিত না) একজন আলিমের চরিত্র হনন করা হচ্ছে। ষড়যন্ত্রের কবলে আসলে কারা?