বই: কাঠগড়া (কষ্টিপাথর-৩)
বিজ্ঞান হল একটা চলমান অনুসন্ধানী কার্যক্রম, আর বিজ্ঞানবাদ হল একটা দার্শনিক অবস্থান ও দৃষ্টিভঙ্গি (worldview)। গবেষণা করার মত প্রকৃতিতে অনেক কিছু থাকলেও, বিজ্ঞানবাদের মূল কার্যক্রম ‘মানুষের বিশ্বাস ও আচরণ’ নিয়ে। স্পষ্ট সীমা ও পদ্ধতি নিয়ে কাজ করার বদলে, সে পুরো ক্ষেত্রটাকে অস্পষ্ট করে ফেলে, জ্ঞানের আর সব রাস্তা বন্ধ করে দিয়ে।
<image1>
বিজ্ঞান দার্শনিক Susan Haack বিজ্ঞানবাদের কয়েকটি লক্ষণের কথা বলেছেন। চলুন দেখে আসা যাক। সাথে একটি করে আমাদের পরিচিত উদাহরণ দিলে কেমন হয়?
প্রথমত.
‘বিজ্ঞান’ ও ‘বৈজ্ঞানিক’ শব্দগুলো যখন প্রশংসাসূচক ও সম্মানজনক কিছু বুঝাতে যথেচ্ছা ব্যবহার করা হবে। ‘বিজ্ঞান’ শব্দটা শুনলেই হয়েছে, ভক্তিতে গদগদ হয়ে পড়বে। বিজ্ঞানের মোড়কে যাই দেয়া হবে সব বিনাপ্রশ্নে মেনে নেবে। যেমন ধরুন জনপ্রিয় বিজ্ঞান-লেখকের বইয়ে আছে:
“মানুষ যদি বিজ্ঞানের ক্ষমতাকে বিশ্বাস না করে, যদি ভয় না পায়, যদি ভরসা না করে, তাহলে কার উপর বিশ্বাস করবে, কাকে ভয় পাবে, কার উপর ভরসা করবে?”
[ড. জাফর ইকবাল, কোয়ান্টাম মেকানিক্স, পৃ ৪৯]
দ্বিতীয়ত
বিজ্ঞানের পদ্ধতি ও টার্মগুলো দরকার হোক বা না হোক, উপকার থাক বা না থাক, দেদারসে ব্যবহার করবে।
তৃতীয়ত.
এই রোগে আক্রান্ত লোকেরা বিজ্ঞান আর অপবিজ্ঞানের পার্থক্য করা নিয়ে খ্যাপাটে-রকম বাতিকগ্রস্ত। কথায় কথায় ‘অপবিজ্ঞান’ ‘কুবিজ্ঞান’ শব্দগুলো প্রয়োগ করবে।
চতুর্থত.
একটিমাত্র বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিকেই বিজ্ঞান-অবিজ্ঞানের পার্থক্যকারী ঠাওরানো। যেন বিজ্ঞানের ছাড়পত্র না পেলে ও কোনো জ্ঞানই না। পদার্থবিদ Ian Hutchinson-এর মতে, বিজ্ঞানবাদ হল প্রকৃতিবিজ্ঞানকেই সত্য জ্ঞানের একমাত্র উৎস ভাবা। যেমন বার্ট্রান্ড রাসেল বলেছিলেন:
“যা জ্ঞান অর্জন সম্ভব, তা কেবল বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতেই করতে হবে। বিজ্ঞান যা আবিষ্কার করতে পারবে না, মানুষ তা কখনও জানতে পারবে না”।
[An Introduction to Philosophy of Science]
পঞ্চমত.
বিজ্ঞানের আওতার বাইরে, এমন সব প্রশ্নের উত্তরে বিজ্ঞানকে টেনে আনা। যেমন বেস্টসেলার বই ‘হোমো-স্যাপিয়েন্স’-এ ইউভাল হারারি দাবি করেন:
“মানুষকে যেমন কখনো সৃষ্টি করা হয়নি, ঠিক তেমনি জীববিজ্ঞানের মতে কোনো স্রষ্টার অস্তিত্ব নেই, যে কি না মানুষকে কোনো আলাদা সম্মান দিয়ে বানিয়েছে”।
[স্যাপিয়েন্স, পৃ ১২৩]
ষষ্টত.
বিজ্ঞান-বহির্ভূত যত কার্যক্রম, সবকিছুকে হেয় করা, অদরকারি সাব্যস্ত করার চেষ্টা করা। দার্শনিক Tom Sorell-এর মতে বিজ্ঞানবাদ হল প্রকৃতিবিজ্ঞান-কে অতিমূল্যায়ন এবং জ্ঞান-সংস্কৃতির অন্যান্য শাখাকে ছোটো করা। দেখুন:
“শুধু বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদরাই পারবেন আমাদেরকে সত্যিকারের পৃথিবী উপহার দিতে”।
[আরো একটুখানি বিজ্ঞান, পৃ ১৩]
“অনেক বইতে সত্যিকথা লেখা থাকে, আবার অনেক বইতে মিত্যা কথা লেখা থাকে। যেগুলোতে সত্যিকথা লেখা থাকে সেগুলোর পণ্ডিতি নাম হল ‘বৈজ্ঞানিক বই’।”
[দেবীপ্রসাদ, যে গল্পের শেষ নেই]