নারীবাদ ও উপনিবেশ: একাল-সেকাল


সতীদাহ প্রথা প্রথম বন্ধ করেছিলেন আকবর। আকবর আইন করে বন্ধ করেন: কেবল স্বেচ্ছায় সতীদাহ হতে চাইলে, পারবে। জোর করে কাউকে সতীদাহ করা যাবে না। হিন্দু সেনাপতি ও রাজরাজড়া নির্ভর মোগল আমলে এর চেয়ে বেশি সম্ভব ছিল না। কেননা, এসব এলিট হিন্দু পরিবারের নারীরাই নিজ পতিভক্তি প্রমাণে এলিটত্ব বজায় রাখতে সতীদাহ হবার ইচ্ছে ব্যক্ত করতো। যেটা হরেদরে বন্ধ করে দেয়াটা পলিটিক্যালি কারেক্ট না। তুলনা করুন, আধুনিক সভ্যতার স্বেচ্ছামৃত্যু কনসেপ্ট ও কিউট সুইসাইড ক্যাপসুলটার ছবিটা। যে মরতে চায়, তাকে মরতে দাও। বাদশাহ আওরঙ্গজেব রহ. এর সময় এই আইনকে আরও নিয়মকানুন ও শর্তের বেড়াজালে আরেকটু ‘অসম্ভবপ্রায়’ করে ফেলা হয়। তবে সত্য কথা হল, সেসময় যাতায়াত ও পুলিশিং এখনকার মতো ছিল না বলে প্রত্যন্ত এলাকায় এই আইন ‘হয়তো’ শতভাগ বাস্তবায়ন হতো না। এবং এটাই স্বাভাবিক। বৃটিশ এসে আইন করে বন্ধ করার পরও ১৯৮৭ সাল অব্দি নানা স্থানে সতীদাহ হয়েছে। যে কারণে আলাপটা পাড়লাম তা শুরু হচ্ছে এখন।

  • নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি প্রাচ্যের খারাপ
  • নারীকে প্রাচ্য ঘরে আটকে রাখে (?)
  • নারীকে জ্যান্ত পোড়ায়
  • নারীকে মানুষ মনে করে না
  • বহুবিবাহ করে
  • বিধবা নারীর প্রতি অমানবিক আচরণ করে
  • বাল্যকালে নারীকে বিয়ে করে
  • নারীকে শিক্ষিত হতে দেয় না
  • হারেমে যৌন-নির্যাতন করে
  • দাসী বানায়

নারীর প্রতি আচরণ যেহেতু সভ্যতার একটা প্যারামিটার এবং তাতে প্রাচ্য যেহেতু পশ্চিমের মতো না, অতএব প্রাচ্য বর্বর-অসভ্য-ইতর। সুতরাং তাদেরকে সভ্য করতে উপনিবেশ প্রয়োজন। প্রচুর লেখালেখি হয়েছে এভাবে ইউরোপে। ইউরোপের জনগণের সমর্থন, পার্লামেন্টের সমর্থন এবং উপনিবেশের নেটিভদের সমর্থন তৈরি করা হয়েছে এভাবে। এটা হচ্ছে নারীর প্রাচ্যবাদী বয়ান। এই ভুল বর্ণবাদী ইউরোসেন্ট্রিক বয়ান প্রাচ্যের সভ্যতা, সংস্কৃতি, সমাজকে বর্বর ও অসভ্য করে চিত্রিত করেছে ইউরোপমানসে। যা পরবর্তী গবেষকদের গবেষণায় বার বার ভুল প্রমাণ হয়েছে। ঐতিহাসিক Judith Still জানিয়েছেন:

Lady Mary Wortley Montagu নিজে হারেমে প্রবেশ করেছেন, আতিথ্য গ্রহণ করেছেন। তিনি বলেছেন: হারেম কোনো কয়েদখানা নয়, বরং নারীদের একান্ত চারণভূমি। তিনি এও বলেছেন, যেসব পুরুষ পর্যটকরা আমাদের ভুলভাল বিশ্বাস করিয়েছে, তাদের চেয়ে তুর্কী নারীরা অনেক বেশি বিচরণশীল।

Judith Still, “Hospitable Harems? A European Woman and Oriental Spaces in the Enlightenment,” Paragraph, 32, no. 1 (2009), 96.

১৮০০ সালের দিকেও ইউরোপীয় পুরুষ ঝগড়াটে বউকে মুখে বেড়ি পরিয়ে বাজারে হাঁটিয়েছে। বউ বিক্রি করার রেওয়াজ ছিল ইংল্যান্ডে। সেই ইউরোপই কেবল ব্যবসার স্বার্থে প্রাচ্য সম্পর্কে ভুল-শুদ্ধ মিলিয়ে এসব কাহিনী ফাঁদা হয়েছে: চালুনি বলে সুই তোর পিছনে কেন ফুটো। আজকের নব্য-উপনিবেশবাদীরাও একই বয়ানে প্রাচ্যে আগ্রাসনের বৈধতা খুঁজছে। বলা হচ্ছে, ইসলাম নারীকে যথেষ্ট অধিকার দেয়নি, আফগানে নারীদের কী হবে, নারীরা কি পারবে স্কুলে যেতে ব্লা ব্লা। ঘুরেফিরে একই আলাপ। প্রথম আলোর মত পত্রিকাগুলো লিখছে। বিন রশিদেরা বলছে। সুর মিলিয়ে ফামা-গং বরকতময় তিন প্রজন্মের ব্যাখ্যাকে অস্বীকার করছে, অপ্রাসঙ্গিকভাবে প্রথম যুগের ঘটনা থেকে বেঁকিয়ে-পেঁচিয়ে মনচাহি ব্যাখ্যা বের করছে। ফিকহ-হাদিসের শিক্ষিকাকে বানিয়ে দিচ্ছে ‘ফিমেল জজ-ব্যারিস্টার’। যেহেতু আমরা পরকীয়া মেনে নিইনা, নারীকে বন্ধুর বাসায় রাতে থাকতে দিই না, ভার্সিটির মেয়েদের সন্ধ্যার পর হলে ফিরতে বলি, নারীরা বাচ্চাকাচ্চার জন্য ক্যারিয়ার বিসর্জন দিচ্ছে, ১৬-১৭ তে নারীদের বিয়ে দিচ্ছি। অতএব আমরা সভ্য হয়ে উঠতে পারিনি, তালব্যনি স্টাইলে চলছি, শিক্ষিত হয়েও নারী বেকার। পশ্চিম থেকে আমাদের কপি-পেস্ট হতে হবে।

নারীবাদ একটা উপনিবেশী এজেন্ডা। সামরিক-অর্থনৈতিকভাবে উপনিবেশ টিকিয়ে রাখা, প্রাচ্য থেকে পশ্চিমে সম্পদের ফ্লো বজায় রাখার বুদ্ধিবৃত্তিক ভিত। ইসলামিক ফেমিনিস্ট থেকে নিয়ে কাঠসেক্যুলার নারীবাদী, প্রত্যেকে এই কলোনিয়াল পার্পাস সার্ভ করে। সিআইএ বলেছে: মিডল ইস্টে আধিপত্য বজায় রাখতে নারীবাদকে ব্যবহার করা হবে। আমেরিকার শক্তিশালী পলিসি থিংকট্যাঙ্ক র্যান্ড বার বার রিসার্চ করে করে এর নির্দেশনা বাতলাচ্ছে। কীভাবে সেই পুরনো প্রাচ্যবাদী বয়ান এখনও সাম্রাজ্যবাদী পলিসি হিসেবে কাজ করে, সেটাই দেখিয়েছেন তরুণ আলিম ও গবেষক হাসসান বিন সাবিত। প্রতিটি মুসলিম নারীকে জানতে হবে তাদেরকে নিয়ে চলা ষড়যন্ত্রের আদ্যোপান্ত। অন্য মুসলিম বোনদেরকে জানাতে হবে। দালালদের থেকে সতর্ক করতে হবে। পুরুষদের আরও গায়রতওয়ালা ও প্যাট্রিয়ার্ক হতে হবে। পুরুষরা বুক টান করে নারীদের আগলাবে, এটাই প্রাচ্যের কালচার। Protect ur women and children, even if u need to die for.

মুসলিম নারীরা এবং উপমহাদেশের নারীরা কখনই বেকার বসে ছিল না। এবং এখনও বেকার বসে নেই। গ্রামে যখন ফসল ওঠে পুরুষ ফসল কেটে মোষের গাড়িতে করে উঠোনে এনে ফেলে। মাড়াই থেকে সিদ্ধ করা সব কাজ মেয়েরা করে এসেছে (যন্ত্রের ব্যবহারের আগে)। প্রোটো-ইন্ডাস্ট্রিয়াল যুগে ঘরে ঘরে মসলিন, রেশম, সুতী কাপড়, বাহারি সব পণ্য (সোনা, তামা, হাতির দাঁত) এসব ছেলেরাএকা একা করেনি। ঘরের মা-বউ-বোনেরা একসাথে করেছে। আড়ং-ব্র্যাক এর পণ্য ওদের উপর নির্ভর, গ্রামে তাঁতী পরিবারগুলোতে এ চিত্র আজও বাস্তব। যন্ত্রবিপ্লব ও পুঁজিবাদী বৃহৎ শিল্পের আশীর্বাদে বৃটিশরা নিজেদের ফ্যাক্টরিতে এদের একসময় কাজ করতে বাধ্য করেছে (আজ যেটা করছে আড়ং ও গার্মেন্টস সেক্টর)। যে পুঁজি নির্মাণ হয়েছে বাঙলা লুটের মালে। নারীকে ঘর থেকে ফ্যাক্টরিমুখী করেছে তখন থেকেই। নারীকে বুঝানো হয়েছে তুমি বেকার। নারীর প্রোডাক্টিভিটির দরুনই পরিবার সঞ্চয় করে। সেই সঞ্চয়ও নিয়ে যায় এনজিও। আর বলে, নারী তুমি বেকার। বাংলার বস্ত্রশিল্প ও কৃষি, ইরান-আফগানের বিখ্যাত গালিচাশিল্প, সিরিয়ার তুলাশিল্পে নারীর অবদান ৫০% ছিল।

প্রাচ্যের নারীর সমস্যা পশ্চিমের মত না। আমাদের সমস্যা আমাদের মতো, আমাদের সমাধানও আমাদের মতো। আন্তর্জাতিকতার নামে পশ্চিমকে কপি-পেস্ট করা সমাধান নয়। সামাজিক বিজ্ঞানগুলো গণিতের মতো ধ্রুব নয়। নানা ফ্যাক্টর সমাজে সমাজে আলাদা। আন্তর্জাতিক নারী দিবসের নামে প্রাচ্যের নারীদের, মুসলিম নারীদেরকে পশ্চিমী হবার জন্য উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। প্রাচ্যের দেশগুলোয় পশ্চিমা নীতি কপি-পেস্ট করা হচ্ছে সরকারি পলিসির মাধ্যমে। সমাধান তো নয়ই, বরং তারা যে সমস্যায় আছে,সেই সমস্যা আমদানি করারই নামান্তর। পুঁজিবাদী ব্যবসায়ী সংস্থাগুলো তাদের বাজার প্রাচ্যে বিস্তার করছে। এরই নাম নব্য-উপনিবেশবাদ। তাইতো ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি আর আড়ং-ব্র্যাক কর্পোরেট কালচারে হুবহু মিল। সেই নামমাত্র পারিশ্রমিক, সহায়তার নামে সম্বলটুকু লুটে নেয়া, সমাজের রুচি বদলে দিয়ে নতুন নতুন প্রোডাক্টের বাজার তৈরি। হুবহু রিপিটেশন।

আমাদের মেয়েরা বেকার না। ঘরে আমাদের মেয়েরা ‘কাজ’ করে। সে কাজ তোমার জিডিপিতে আসে না, সেটা তোমার হিসেবের সমস্যা। ঘরের কাজের ওয়ার্ক ভ্যালু বাইরের কাজের ওয়ার্ক ভ্যালুর চেয়ে ২/৩ গুণ বেশি। এখন অবশ্য ঘরের কাজকে জিডিপিতে অন্তর্ভুক্তি আওয়াজ তোমরাই উঠাচ্ছো। [১] তাহলে এতোদিন ‘বেকার’ ‘বেকার’ বলে কান ঝালাপালা করলে কেন? একজন মহিলা/পুরুষ জজের চেয়ে একজন গৃহিনীর কাজের ওয়ার্ক ভ্যালু অর্থনীতিবিদদের মতে বেশিই হবে, কম না। [২]

আন্তর্জাতিক অমুক দিবসের নামে পশ্চিমের কপি-পেস্ট চাই না। পশ্চিমের উপনিবেশ হতে চাই না আবার। দালালদের চিনুন। দালালি প্রকাশ করে দিন। আমরা আমাদের মতো। আমাদের সমস্যা সমাধানে আমরাই যথেষ্ট।

রেফারেন্স:

[১] Include women’s household contribution in GDP (The Daily Star, 2017)
Women’s household work in GDP ( The Financial Express, 2017)

[২] গবেষণায় এসেছে, non-SNA [System of National Account] কাজে নারীদের কাজের চাপ ও সময় পুরুষের চেয়ে ৩ গুণ বেশি। “Women’s Unaccounted Work and Contribution to the Economy”-নামের স্টাডিতে পাওয়া গেছে, যদি নারীর এই ঘরের কাজকে টাকায় পরিণত করা হয় তাহলে তা দাঁড়াবে জিডিপির ৭৬.৮% থেকে ৮৭.২%। বেতনভুক্ত আয়ের চেয়ে তা ২.৫ থেকে ২.৯ গুণ বেশি। Include unpaid work of women in GDP (The Daily Star, 2019)


Leave a Reply