মধ্য বাংলার যুগ: আসল ঠিকাদার
১৩ শতকের শুরুতেও আমরা অপরিণত বাংলা (প্রোটো-বাংলা) পাই কথ্য ভাষা হিসেবে। সেন আমলে দমন পীড়নের মাঝেও কারা সে ভাষা টিকিয়ে রাখল দেখা যাক। ডক্টর নীহাররঞ্জন রায়ের ভাষায়,
সেই অপরিণত বাংলা ১৩শ শতক ধরে দ্রুত পরিণত হয়ে ওঠে মুসলিম শাসকদের হাত ধরে হাঁটি হাঁটি করে। অধ্যাপক শাহনেওয়াজ লেখেন:
“বাংলা ভাষা, সাহিত্য সর্বোপরি বাঙালির সৌভাগ্য যে বিদেশাগত সুলতানরা বাংলার শাসন ক্ষমতায় এসে অচিরেই নিজ কর্মভূমিকায় বাঙালি হয়ে গেলেন। … বাংলার অবাঙালি শাসকরাও ততদিনে বাংলার জল-মাটির সঙ্গে একাকার হয়ে গিয়েছেন। পিতৃভূমিতে ফিরে যাওয়ার কোনো আগ্রহ আর তাদের ছিল না। সুতরাং বাংলা আর বাঙালির শ্রীবৃদ্ধিতে তারা অকুণ্ঠ চিত্তে ভূমিকা রেখেছেন। সুলতানদের কর্মভূমিকায় যে উদারতা দেখা গেছে এর প্রেক্ষাপটও খুঁজতে হবে এখানেই। সুলতানরা অনুভব করেছিলেন, বাঙালির প্রকৃত সংস্কৃতিকে বিকশিত করেই তাদের মনন অনুভব করা যাবে। রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারণে এর প্রয়োজন ছিল এ কারণেই।… সেনযুগের বদ্ধ অর্গল খুলে গেল সুলতানদের উদার নীতিতে। ধর্ম-নির্বিশেষে সব শ্রেণির মানুষের মধ্যে শিক্ষা ও সাহিত্যচর্চার দ্বার অবারিত হলো। বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় জোয়ার তীব্র হলো। অচিরেই তার ফসল দেখা দিল। প্রসারিত হলো বাংলা ভাষা চর্চার ক্ষেত্র। এ ভাষায় কাব্য সৃষ্টি হতে থাকল। বাঙালি কবির রচনায় সৃষ্টি হলো মঙ্গল কাব্যের বিশাল ভান্ডার”। [১]
এ কে এম শাহনাওয়াজ (অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়) | ৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ সুলতানি আমলে বাংলা ভাষার বিকাশ, দেশ রূপান্তর।
শ্রী দীনেশ চন্দ্র সেন লেখেন,
” মুসলমান আগমনের আগে বঙ্গভাষা কোনো কৃষক রমণীর ন্যায় দীনহীন বেশে পল্লী কুটিরে বাস করিতেছিলো। …হীরা কয়লার খনির মধ্যে থাকিয়া যেমন—জহুরির আগমনের প্রতীক্ষা করে, শুক্তির ভিতর মুক্তা লুকাইয়া থাকিয়া যেরূপ ডুবুরীর অপেক্ষা করিয়া থাকে, বঙ্গভাষা তেমনই কোনো শুভদিন, শুভক্ষণের জন্য প্রতীক্ষা করিতেছিল। মুসলমান বিজয় বাঙ্গলা ভাষার সেই শুভদিন, শুভক্ষণের সুযোগ আনয়ন করিল। গৌড়দেশ মুসলমানগণের অধিকৃত হইয়া গেলো। তাঁহারা ইরান-তুরান যে দেশ হইতেই আসুন না কেন, বঙ্গদেশ বিজয় করিয়া বাঙ্গালী সাজিলেন“।
(শ্রী দীনেশচন্দ্র সেন, প্রবন্ধ : বঙ্গ-ভাষার ওপর মুসলমানের প্রভাব, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে মুসলিম অবদান, পৃষ্ঠা : ১৮-১৯)
তিনি বলেন:
“তুর্কিরা এদেশে বাস করিয়া এদেশের একরূপ অধিবাসী হইয়া পড়িয়াছিলেন, তাঁহারা বাঙ্গালা কথা কহিতে ও লিখিতে জানিতেন।…
[দীনেশচন্দ্র সেন, বৃহৎ বঙ্গ, খণ্ড-২, প্রাগুক্ত, পৃ. ৯৭৭।]
আচার্য দীনেশ চন্দ্র সেন আরও মন্তব্য করেছেন,
“আজ হিন্দুর নিকট বাঙ্গলাদেশ যেমন মাতৃভৃমি, সেদিন হইতে মুসলমানের নিকট বাঙ্গলাদেশ তেমনই মাতৃভুমি হইল৷ তাঁহারা এদেশে আসিয়া দস্তুরমত এদেশবাসী হইয়া পড়িলেন৷ হিন্দুর নিকট বাঙ্গলা ভাষা যেমন আপনার, মুসলমানদের নিকট উহা তদপেক্ষা বেশী আপনার হইয়া পড়িল৷
বঙ্গভাষা অবশ্য বহু পূর্ব হইতে এদেশে প্রচলিত ছিল, বুদ্ধদেবের সময়ও ইহা ছিল, আমরা ললিত বিস্তরে তাহার প্রমাণ পাইতেছি। কিন্তু বঙ্গ-সাহিত্যকে একরূপ মুসলমানের সৃষ্টি বলিলেও অত্যুক্তি হইবে না।… মুসলমান সম্রাটগণ বর্তমান বঙ্গ- সাহিত্যের এইরূপ জন্মদাতা বলিলেও অত্যুক্তি হয় না। … বঙ্গ সাহিত্য মুসলমানদেরই সৃষ্ট, বঙ্গভাষা বাঙ্গালী মুসলমানের মাতৃভাষা।”
[ সুত্র : দীনেশ চন্দ্র সেন বঙ্গ-ভাষার উপর মুসলমানের প্রভাব, ‘সওগাত’, ১৩৩৫ সালের চৈত্র সংখ্যায় প্রকাশিত, সংগৃহীতঃ বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে মুসলিম অবদান, মোশাররফ হোসেন খান (সম্পাদিত)]
২য় পর্ব
৪র্থ পর্ব