ডাবল স্ট্যান্ডার্ড-৩ বইয়ের একটি গল্প। নারীশিক্ষার আলাপটা বুঝতে সাহায্য করবে। আগের [ক] এর সাথে পরের [ক] মিলিয়ে পড়বেন। বা পরে [ক] পেলে আগের [ক] টা খুঁজে মিলিয়ে নেবেন। যেখানে ফুটনোট সাথে সাথে পড়ে ফেলবেন। ফুটনোটগুলো জরুরি।
শীতের সময় শীতটাই শরীরের জন্য ভালো। গরমের সময় গরমটাই। বছরে ঋতু পরিবর্তন প্রাণিজগৎ, ফসল উৎপাদন, মন সবকিছুর জন্যই দরকারি। দরকারি বলেই তা হয়। হবে বলেই আমাদের শারীরবৃত্ত এমন। এসি ভালো লাগে বটে, তবে গরম ঋতুর সময় কৃত্রিম শীত তৈরি করে রাখা আপনার জন্য সুখকর হলেও শরীরী ব্যবস্থাপনার জন্য কতটুকু সুখকর—তা গবেষণার দাবি রাখে বৈকি। জোর করে চাপিয়ে দেওয়া কিছুর বিরুদ্ধে যেকোনো সিস্টেম বিদ্রোহ করে একটা সময়। দেহের সিস্টেমের বিদ্রোহটা হাজির হয় অসুখবিসুখ আকারে।
অসহ্য গরম পড়েছে ক’দিন। ঝেড়ে বৃষ্টি হওয়ার দরকার। আধখেঁচড়া না। অল্পবিদ্যে যেমন ভয়ঙ্করী, অল্পবৃষ্টিও প্রলয়ঙ্করী। গরম বেড়ে যায়। শীতের শেষে এই সময়টা বেশ জঘন্য। রোদের হিট বেশি, বাতাসে হিউমিডিটি বেশি, শীতের আস্কারাপ্রাপ্ত ধুলাবালি বেশি, গাঁওগেরামের দিকে আবার শেষরাতে ঠান্ডাও পড়ে। একটা ভজঘট অবস্থা। পুরো দুনিয়া দুআ করছে একটু বৃষ্টির জন্য।
যা হোক। তিথিরা শীতকালটা গ্রামে শ্বশুর-শাশুড়ির সাথে থাকে। শীত যাই যাই করছে, সাথে তিথিরাও। শীতেরও যাওয়া হয়ে উঠছে না, এই-সেই প্রোগ্রাম করে করে ওদেরও যাওয়া হচ্ছে না। তিথির ননদ মিনুকে ছেলেপক্ষ দেখতে আসবে এই শুক্রবার। সুতরাং যাওয়া আবারও পিছিয়েছে। মিনু মোটে রাজি না বিয়েতে। মাসুদ বোনের জন্য ছেলে পছন্দ করেছে, তাই ছেলে হুজুর টাইপ। মিনু হুজুর ছেলে বিয়ে করবে না। ভাবী হিসেবে বুঝাতে গিয়েছিল তিথি। হুজুরে মিনুর কী সমস্যা? কেঁচোর বদলে ধীরে ধীরে বেরিয়ে এলো নানান রকম কেউটে। ইসলাম নিয়েই সমস্যা। নাস্তিক-ফেমিনিস্টদের ব্লগম্লগ পড়ে মাথায় ভর্তি করেছে গোবর্জনা।
‘ইসলাম তো নারীকে মানুষই মনে করে না, ভাবী। আধামানব মনে করে। পুরুষ যা, নারী হলো তার অর্ধেক। যেমন—মীনা অর্ধেক ডিম আর রাজু পুরো ডিম। এই গ্রাম্য মূর্খ মাইন্ডসেটের সাথে ইসলামের পার্থক্য কোথায়?’ দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে তিথি মিনুর এসব প্রশ্ন শুনে।
‘জবাব চাও, নাকি বোল্ড করার জন্য প্রশ্ন?’
‘জবাব নেই ভাবী। স্পষ্ট আয়াত। তাও কুরআনের। দুই মেয়ের সমান সম্পদ পাবে ছেলে।[১০৬] দুই নারী সাক্ষীর সাক্ষ্য এক পুরুষ সাক্ষীর সমান।[১০৭] সোজা বাংলা। কোনো ব্যাখ্যা দিয়েই এত স্পষ্ট জিনিস বদলানো সম্ভব না।’ মিনু নাছোড়।
‘আচ্ছা, তুমি এখন জবাব শোনার অবস্থায় নেই। পরে কখনো আমরা এ নিয়ে আলাপ করব। কেমন?’
‘ঠিক আছে, ভাবী।’
হে মানুষ, তোমার বড়োই তাড়াহুড়া। টেস্ট খেলা হতো ৫ দিনের। কে দেখবে ৫ দিন? এলো ওয়ানডে। সারা দিন বসে বসে দেখা যায়? হবে না। এলো টি-টুয়েন্টি। তাতেও হচ্ছে না, শুনলাম ১০ ওভারের খেলা আসছে। ৫ দিনের বিনোদন ২ ঘণ্টায় চাই। ৩ ঘণ্টা পূর্ণদৈর্ঘ্য সিনেমার মজা ৩০ সেকেণ্ডের টিকটকে চাই। দ্রুততম সময়ে আমার চাহিদা পুরা হওয়া চাই। সময় কম, কুইক। নাপায় এখন আর চলছে না, বাজারে এসেছে Napa Rapid. ফাস্টফুড, ফাস্টট্র্যাক, ফাস্টক্যাশ, ফাস্ট… ফাস্ট… ফাস্ট…
উত্তর চাই : হ্যাঁ কিংবা না। লিংক দাও। একটাই রিসার্চ পেপার দাও, এতগুলো পড়ে বুঝে নিতে পারব না। বই পড়তে পারব না, বড়ো পোস্ট পড়তে পারব না, কমেন্টে বলো। এত সহজ? প্রশ্নপত্র হয় ছোট্ট ১ পৃষ্ঠা। উত্তর লিখতে লাগে লুজের পর লুজ। সুতরাং প্রশ্ন করে ফেলা সহজ। জবাব খুঁজে নেওয়া কষ্টসাধ্য, সময়সাপেক্ষ। সুতরাং কে খুঁজতে যাবে জবাব। উত্তর কেউ কাউকে দিয়ে দেয় না। উত্তর আপনিই দেন আপনাকে। আমি আপনাকে যতই উত্তর দেখাই, কোনো জবাবই জবাব না, যতক্ষণ না আপনি নিজেকে নিজে জবাব দিচ্ছেন। আমরা বড়োজোড় কাউকে জবাবের সন্ধান দিতে পারি, জবাব দিতে পারি না।
——————–
[১০৬] ‘আল্লাহ তোমাদেরকে তোমাদের সন্তানদের সম্পর্কে আদেশ করেন : একজন পুরুষের অংশ দুজন নারীর অংশের সমান।…’ [সূরা নিসা, আায়াত : ১১]
[১০৭] ‘আর তোমরা তোমাদের পুরুষদের মধ্য হতে দুজন সাক্ষী রাখো। অতঃপর যদি তারা উভয়ে পুরুষ না হয়, তাহলে একজন পুরুষ ও দুজন নারী—যাদেরকে তোমরা সাক্ষী হিসেবে পছন্দ কর। যাতে তাদের (নারীদের) একজন ভুল করলে অপরজন স্মরণ করিয়ে দেয়।’ [সূরা বাকারা, আয়াত : ২৮২]
——————–
তক্কে তক্কে ছিল তিথি। যেদিন মিনুর মন ভালো থাকবে, সেদিন ওর ফাইল ধরা হবে। আজ একটা মোক্ষম সময়। সকাল ১০টার দিকে সেকি ঝুম বৃষ্টি। ঘরের মেয়েছেলেরা বৃষ্টিতে খুব ভিজে নিয়েছে ছাদে সবাই। আজ নিশ্চয়ই মেজাজ শরিফ। তিথি যেটা করল, সেটা হলো—চমৎকার করে মুড়ি মাখালো, কুচি করে সালাদ কাটল, বেগুনি ভাজল। Enter someone’s heart through stomch. মিনু ঘরেই আছে। বৃষ্টিবাদলার দিন। কোথাও বেরোবার সম্ভাবনাও কম।
‘শোনো মিনু, কীভাবে যে উদাহরণ দিই। ধরো তোমার এই মাউস, এই কীবোর্ড।’
‘আচ্ছা ধরলাম’, গালে হাত দিয়ে চায় মিনু।
‘মাউসটা ছোটো, কীবোর্ডটা বড়ো। যে উদ্দেশ্যে কীবোর্ড তৈরি, সে উদ্দেশ্য পূরণে তাকে অত বড়োই হতে হবে। মাউস যে উদ্দেশ্যে তৈরি, তাতে ওকে কীবোর্ডের মতো অত বড়ো না হলেও চলবে; বড়ো হলেই বরং সমস্যা, মাউসের মূল কাজটা করাই দুষ্কর হবে। এখন বলো, এদের কেউ কি গুরুত্বে ছোটো-বড়ো? নাকি, দুটোই প্রয়োজন ও সমান গুরুত্ব রাখে?’
‘আচ্ছা’, তর্কের খাতিরে মেনে নেওয়ার মতো মেনে নিল মিনু।
‘দুজনে মিলে একটা বৃহত্তর উদ্দেশ্য সার্ভ করে। জানি না, উদাহরণটা হলো কি না। আকার বড়ো বলেই কীবোর্ডের মর্যাদা বাড়েনি, আকারে ছোটো বলে মাউসের মর্যাদা কমেনি। তুমি কি চোখে দেখতে পাচ্ছ না নারী-পুরুষ আলাদা?’
‘গঠনে আলাদা হতে পারে, যোগ্যতায় আমরা আলাদা নই। নারী-পুরুষ সমান যোগ্য।’, শীতল কণ্ঠে মিনুর জবাব। ততটাই উষ্ণ গলা করে তিথি বলে :
‘আচ্ছা, ‘সমান যোগ্য’ কথাটা বলার আগে কখনো ভেবেছ, ঠিক কেন আমরা গঠনে আলাদা?’
‘উমমম…কেন?’
‘নারী-পুরুষ তো এমন আলাদা নাও হতে পারত। গঠনে আলাদা মানে আমাদের গঠনের উদ্দেশ্য আলাদা। ফাংশন আলাদা। ভূমিকা আলাদা। ফাংশন আলাদা না হলে তো গঠন আলাদা হওয়ার দরকার নেই, না?’
এই চোখের দেখা-টা কী করে অবিশ্বাস করা যায়? নাস্তিকরা বলে : স্রষ্টা নেই; কারণ, তাকে দেখতে পাই না। নারীবাদ বলছে : আবার যা যা দেখতে পাই, তাও বিশ্বাস করা যাবে না। পুরুষাঙ্গ দেখছ মানেই পুরুষ, তা না। লিঙ্গ মানেই জেন্ডার না। কী অদ্ভূত এই সভ্যতা, না? তিথি বলতে থাকে :
‘ফাংশন আলাদা না হলে, গঠন আলাদা হওয়ার কী দরকার ছিল, বলো? সে তুমি বিবর্তনেই বিশ্বাসী হও, আর আল্লাহতেই বিশ্বাসী হও। নারী-পুরুষ পৃথক বৈশিষ্ট্য নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে বা বিবর্তিত হয়েছে, আলাদা ফাংশনের জন্য। ঠিক মাউস-কীবোর্ডের মতো। মানবসম্প্রদায়ের সদস্য হিসেবে আমরা উভয়ে মর্যাদায় যে সমান, এটা নিয়ে কারও কোনো কথা নাই; কিন্তু একটা ‘ব্যবস্থাপনাগত (সিস্টেম) উদ্দেশ্যে’… তিথি কৌট সাইন দেখায় দুইহাত কানের পাশে নিয়ে।.. ‘আমাদেরকে পৃথক শরীর দেওয়া হয়েছে একইভাবে ঠিক ওই কারণেই আলাদা মনোদৈহিক সক্ষমতা, দক্ষতা ও আগ্রহ দেওয়া হয়েছে। এখন বলো মিনু, কী সেই কারণ? কী সেই ব্যবস্থাপনা, যার জন্য আমাদেরকে নারী-পুরুষে আলাদা করতেই হলো?’
‘সন্তান ধারণের কথা বলছ?’, মিনুকে আগ্রহী মনে হচ্ছে। আসলে ব্যাপারগুলো এত স্পষ্ট। এত স্পষ্ট জিনিসগুলো অস্বীকার করা যায় কীভাবে কে জানে।
‘ঠিক তাই। প্রজাতির কন্টিনিউয়েশন। প্রজাতির ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে কেউ নারী, কেউ পুরুষ। এ ছাড়া দেখো তুমি, এই দুই ভাগে ভাগ হওয়ার আর কোনো কারণ নেই। প্রজাতি রক্ষার জন্য প্রতিটি উদ্ভিদ প্রতিটি প্রাণীর নিজ নিজ বৈশিষ্ট্য আছে। যেমন ধরো :
মেহগনির বীজ হেলিকপ্টারের মতো বাতাসে ভেসে ভেসে মায়ের ছায়া থেকে দূরে গিয়ে পড়ে। শিমুলের তুলার মাঝে থাকে বীজ। যাতে তুলাটা উড়ে বীজটা গাছের তলা থেকে দূরে গিয়ে পড়ে। যেখানে আলো বেশি পাবে সে। আবার ধরো, ইঁদুর-খরগোশ প্রচুর বাচ্চা দেয়, যাতে মরেটরে এতে-ওতে খেয়েও অনেকে বেঁচে যায়, এই বেশি বাচ্চা দেওয়াটা ওদের টিকে থাকার কৌশল। অর্থাৎ প্রজাতি টিকিয়ে রাখার ফিচার রয়েছে প্রতিটি জীবের মাঝে। জীবজগতের প্রধান উদ্দেশ্যই এটা’।
‘আচ্ছা’, মুড়িমাখাটা জন্মের টেস্ট হয়েছে। দাওয়াহর ক্ষেত্রে একটা পজিটিভ পরিবেশ তৈরি করতে হবে। আপনি কথা বলবেন, আর চারপাশের সবকিছু তাকে একটা পজিটিভ অনুভব দেবে। এমন পরিবেশে দাওয়াহ বেশি ফল দেয়। মসজিদ এমন একটা পরিবেশ। মসজিদে এনে দাওয়াহ দিতে পারলে রেজাল্ট পাবেন দ্বিগুণ।
‘মানুষের মাঝে আসি এবার। দেখো মিনু, নারীর নারীসুলভ এটিটিউড পুরুষকে আকর্ষণের জন্য। নারীর কথা বলার ভঙ্গি, নন-ভার্বাল কমিউনিকেশন, হাঁটা, দেহভঙ্গি, চাহনি, ঢঙঢাঙ এমনকি চুলবাঁধা পর্যন্ত। ছেলেরা এগুলা নিয়েই পাগল হয়ে থাকে। ওই যে কথায় বলে না, নারী ষোলোকলা জানে। দেখোনা, কবিতা-গান-সাহিত্যের বেশিরভাগই এসব নিয়ে। নারীর সেকেন্ডারি সেক্সুয়াল বৈশিষ্ট্যগুলোও[১০৮] পুরুষকে মিলনে আগ্রহী করার জন্য৷ সুতরাং নারীপুরুষ বায়োলজি-সাইকোলজি এমনভাবেই তৈরি, যাতে অটোমেটিক প্রজাতির ধারা অব্যাহত থাকে। একদিকে নারীর পেলভিসের গঠন, স্তনগঠন সন্তানধারণ ও লালনের জন্য। পেলভিস বড়ো হতে গিয়ে আবার কোমর হয়ে গেছে চিকন, হাঁটার ভঙ্গি হয়ে গেছে অন্যরকম; এসব ওদিকে পুরুষকে আবার আকর্ষণ করে।[১০৯] সন্তান ধারণ ও পালন নারীর মূল জৈবিক ফাংশন, যার জন্যই সে জৈবিকভাবে নারী। এই ফাংশনের যোগ্যতা ঠিক রাখতে গিয়ে আবার অন্যদিকে ছাড় দিতে হয়েছে। ঠিক যেমন মাউসকে তার কাজ সঠিকভাবে করতে হলে ছোটো হতে হবে, হাতের মুঠোয় আঁটতে হবে।’
‘কীসে কম হয়েছে নারী?’, এ-জাতীয় কথা কোনোদিন শোনেনি মিনু। সত্য স্বতঃপ্রকাশিত; কিন্তু এরপরও অধিকাংশ মানুষ সত্যকে পায় না। কারণ, সত্যকে ‘ভেবে’ পেতে হয়। মগজে শ্রম লাগে সত্য পেতে। তোমরা কি ভাবো না? আফালা তা’ক্বিলুন।
‘যেমন ধরো, পেলভিস বড়ো রাখতে গিয়ে হাঁটু দুটো কাছে চলে এসেছে, ফলে দৌড়াদৌড়ি অসুবিধাজনক হয়ে গেছে। অতিরিক্ত শক্তি সঞ্চয়ের জন্য প্রচুর চর্বি জমা হয়েছে,[১১০] ফলে
ত্বক হয়েছে মসৃণ, যা পুরুষের আকর্ষণ; আবার এর ফলে ওদিকে ঘাম কম হয়; গরমে বেশি গরম লাগে,[১১১] শীতে ঠান্ডা বেশি লাগে গড়পড়তা।[১১২] মাসিকের ব্যবস্থা রাখতে হয়েছে, ফলে অতিরিক্ত দৈহিক ও আবেগিক বিশ্রামের মুখাপেক্ষী হতে হয়েছে।[১১৩] শরীরে ও মনে অল্প স্ট্রেস পড়লেই নারী কাতর হয়।[১১৪] মানে প্রতিকূল পরিবেশে নারীর দুর্বলতা তৈরি হয়েছে। কেন? ওই যে সন্তান ধারণের ব্যবস্থাপনা রাখতে গিয়ে। ব্যবস্থাপনাগত কারণে নারীর মাঝে যে দুর্বলতা এসেছে, সেটাকে কাভার দিতে পুরুষকে লাগবে।’ তিথি দম নেয় খানিক। লড়াই এখনও ঢের বাকি।
——————–
[১০৮] স্তনগঠন, কোমর চিকন হওয়া, স্তন-নিতম্বে-উরুতে চর্বি জমা, কণ্ঠস্বর চিকন, ত্বক মসৃণ হওয়া ইত্যাদিকে বলে secondary sexual characteristics. মিলনে যে অর্গাজম (চরমানন্দ), সেটাও উভয়কে বেশি বেশি মিলনে আগ্রহী করার জন্য।
[১০৯] মেয়েদের হাঁটার কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে : (Morris, 2013) তাদের নিতম্ব অস্থিচক্র পেলভিস বেশি ঘোরে নিতম্ব উপরে-নিচে আন্দোলিত হয় বেশি (vertical motion at the hip) পদক্ষেপ হয় ছোটো ছোটো মিনিটে স্টেপ নেয় বেশি।
[১১০] দেহের মোট চর্বির ৮০-৯০% থাকে চামড়ার নিচে। আর একই BMI-এ পুরুষের তুলনায় নারীদের ~১০% বেশি চর্বি থাকে দেহে। Karastergiou, K., Smith, S. R., Greenberg, A. S., & Fried, S. K. (2012). Sex differences in human adipose tissues – the biology of pear shape. Biology of sex differences, 3(1), 13.
——————–
আসলে দেখেন, নারী-পুরুষ সম্পর্কটাই ছিল এমন। নারীর দুর্বলতাগুলো পুরুষ পূরণ করবে, পুরুষের দুর্বলতাগুলো পূরণ করবে নারী। পরস্পর পরস্পরকে পরিপূরণ করবে, একে অন্যের পরিপূরক। এভাবে পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল এক বুনটে গঠিত হবে পরিবার—যার ক্যানভাসে আঁকা হবে জাতির ভবিষ্যতদের। আজ এই নির্ভরশীলতা-টা নেই। দুজনই ভাবছে : আমি কম কীসে? যেহেতু আমি কম না, আমার দুর্বলতা নেই, সেটা পূরণ করার জন্য কাউকে দরকারও নেই। পুরুষও টাকাকেই একমাত্র রিসোর্স মনে করছে, সেটার জন্য নারীকে খোঁটা দিচ্ছে, জোর করছে। নারীর ওপরও যে সে কিছু বিষয়ে নির্ভরশীল, সেটা পুরুষ ভুলে যাচ্ছে। সেই রিসোর্সগুলোকে ছোটো মনে করছে। পুরো সিস্টেমটাই নষ্ট করে দিয়েছে পুঁজিবাদ।
——————–
[১১১] যখন বেশি ঘামার প্রয়োজন, যেমন গরম আবহাওয়া নারীর জন্য খানিকটা অস্বস্তিকরই বটে। জাপানের Osaka International University এবং Kobe University-র যৌথ গবেষণায় এমনটিই উঠে এসেছে। গবেষণার প্রধান সমন্বয়ক Yoshimitsu Inoue জানাচ্ছেন, মেয়েদের শরীরের পানির পরিমাণ এমনিতেই পুরুষের চেয়ে কম। ফলে দ্রুত পানিশূন্যতা হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই হতে পারে—এই কম ঘামাটা নারীদের জন্য গরমে একটা সারভাইভাল কৌশল বা অভিযোজন। আর পুরুষের এই বেশি ঘামাটা কাজে দক্ষতা বজায় রাখার একটা কৌশল। গরমে মেয়েদের বেশি যত্ন নিতে সুপারিশ করেছেন গবেষকবৃন্দ (Ichinose-Kuwahara, ২০১০)।
[১১২] নারীদেহে ক্রিয়াবিক্রিয়ার হার (metabolic rate) কম। তাপ উৎপাদন হয় কম। Warwick Medical School –এর Professor Paul Thornalley বলেছেন BBC-কে। (Kingma, ২০১৫) Women feel the cold more than men do because of our metabolisms, Her.ie.
[১১৩] Heavy periods, NHS, UK. রিসার্চ জানাচ্ছে, মাসিকের আগে মেয়েদের যে খারাপ লাগে, যাকে বলে Premenstrual Syndrome বা PMS (পরিশিষ্ট ৮)। এই PMS-এ ৯০% নারীই কোনো-না-কোনো মাত্রায় ভোগে’। (Winer, 2006) আমেরিকার গাইনী ডাক্তাররা এই রোগের যে শর্ত দিয়েছে তার ৫ নং ক্রাইটেরিয়াই হলো : identifiable dysfunction in social and economic performance. মানে, লক্ষণগুলোর কারণে সামাজিক ও অর্থনৈতিক পারফর্মেন্সে ‘চোখে পড়ার মতো’ কমতি আসবে। এবং এই ক্রাইটেরিয়া অনুসারে 85.6% নারীই এতে ভোগেন।
[১১৪] স্ট্রেসের লক্ষণগুলো নারীদের বেশি প্রকাশ পায়। কারণ, একই স্ট্রেসে নারীদের স্ট্রেস-হরমোন কর্টিসল বেশি বের হতে থাকে (Verma, 2011)। ফলে স্ট্রেসে থাকা একজন পুরুষের চেয়ে স্ট্রেসে থাকা একজন নারীর শারীরিক ক্ষতি বেশি হয়, মানসিক অসুখও বেশি হয়। এজন্য অটোইমিউন ও functional disease-গুলো নারীদের অনেক বেশি হয় (হিস্টিরিয়া, এংজাইটি নিউরোসিস, টেনশন হেডেক, Irritable bowel syndrome, Fibromyalgia, Chronic pelvic pain, Cyclic vomiting syndrome, Interstitial cystitis, Chronic fatigue syndrome (CFS) ইত্যাদি)। Stress and your health, Office on Women’s Health, U.S. Department of Health and Human Services
——————–
‘আবার দেখো মিনু,পুরুষের দেহমন স্ট্রেস নেওয়ারই উপযোগী। জীবিকা উপার্জন, যুদ্ধ, সুরক্ষা দেওয়া, যেকোনো পরিবেশে অব্যাহত শ্রম দিতে পারা, প্রতিপত্তি, প্রতিযোগিতা ইত্যাদি। এজন্য পুরুষের লাগবে চওড়া কাঁধ, পেশিবহুল শরীর, শক্ত হাড্ডি, রাফ ত্বক, ভরাট কণ্ঠ। এই ফিচারগুলো মেয়েরা অবচেতনে পছন্দ করে। সৃষ্টিগত বা বিবর্তনগতভাবে আমাদের মানসে এটা আছে, এই পুরুষটাই আমার ও আমার সন্তানের জন্য পারফেক্ট। দেখলে তো, শারীরিক গঠনের পার্থক্য এমনভাবে এসেছে, যাতে নারী-পুরুষের কেন্দ্রীয় উদ্দেশ্য আলাদা হয়ে গেছে। পুরুষ বাইরে প্রতিকূলতা চষে বেড়াবে, জীবিকা আনবে, প্রতিপত্তি দিয়ে নারী-শিশুর জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করবে। আর নারী ঘরে অনুকূল পরিবেশে সন্তান সামলাবে, সন্তানকে স্বাবলম্বী মানব হিসেবে জীবনযুদ্ধের জন্য রেডি করবে। এটা হচ্ছে আমাদের বায়োলজিক্যাল ভূমিকা। জেন্ডার রোল পুরোটাই সমাজ শেখায় না। আমাদের দেহমনের নকশার ভেতরে আছে জেন্ডার রোল। নিজ বায়োলজির বিরুদ্ধে গেলে কী হবে বলো তো?
‘দেহের বিরুদ্ধে গেলে?’
‘হ্যাঁ?’
‘কী আর হবে? অসুখ-বিসুখ হবে’, ভাবীর কথাগুলো মিনুর শরীরে সূঁচের মতো বিঁধছে; কিন্তু ফেলেও দিতে পারছে না। ভাবী যা বলছে এগুলো জানতে তো পড়াশোনার দরকার নেই। চারপাশে নিজের জীবনের সাথে মেলালেই বোঝা যায়।
‘ঠিক বলেছ। একে বলে স্ট্রেস। যখন একটা পরিস্থিতি আমাদের শারীরিক ও মানসিক ক্ষমতার বাইরে চলে যায়, তাকে স্ট্রেস বা ধকল বলে (Lazarus & Folkman, 1984)। বড়ো বড়ো সব অসুখবিসুখের বড়ো কারণ স্ট্রেস। জেন্ডারের নামে বায়োলজিকে অস্বীকার করে নারীরা নিজেদের অসুস্থ করে ফেলছে,[১১৫] পরবর্তী প্রজন্মকে অসুস্থ করে ফেলছে।[১১৬] শুধু এতটুকু আজ জেনে নাও। বাকিটা পরে আলাপ করব কখনো।’
——————–
[১১৫] নারীদের স্ট্রেসের মূল কারণ : অফিসে ও বাসায় নারীর দ্বৈত ভূমিকাই তাদের কর্মস্থলে পুরুষের চেয়ে বেশি স্ট্রেস অনুভব করার মূল কারণ। (Prasad, 2016) পুরুষের মাঝে কাজ করতে সে বেশি স্ট্রেস ফিল করে, সেখানেই তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। ২০১২ সালে ২২,০০০ নারীর ওপর এক রিসার্চে এসেছে, যেসব নারীদের চাকুরি-কেন্দ্রিক স্ট্রেস (job-related stress) বেশি, তাদের ৪০% বেশি সম্ভাবনা হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোক (cardiovascular event) হওয়ার [Alexandra Sifferlin (August 25, 2015) Women in Male-Dominated Jobs Have More Stress, TIME] নারী কর্মকর্তারা বেশি স্ট্রেস, উদ্বেগ ও মানসিক সমস্যার সম্মুখীন [Why Women Feel More Stress at Work (Harvard Business Review 2016)] ব্রিটেনের মতো দেশেই ৭৯% নারী কর্মক্ষেত্রের স্ট্রেসে ভুগছেন, ৭৮% নারী কর্মজীবীর ঘুমে সমস্যা, মোটের ওপর ৮৭% নারী চাকুরি নিয়ে স্ট্রেসে আছেন বলে জানিয়েছেন। [Louise Chunn (Mar 26, 2019) Women Are at Breaking Point Because of Workplace Stress : Wellbeing Survey from Cigna, Forbes.com] ফলে নারীর নিজের ক্ষতি : পুরুষের চেয়ে স্ট্রেসে থাকা একজন নারীর শারীরিক ক্ষতি বেশি হয়, মানসিক অসুখও বেশি হয়। [Stress and your health, Office on Women’s Health, U.S. Department of Health and Human Services] স্ট্রেসের প্রভাবে লক্ষণগুলো নারীদের বেশি প্রকাশ পায়। কারণ, একই স্ট্রেসে নারীদের স্ট্রেস-হরমোন কর্টিসল বেশি বের হতে থাকে’(Verma, 2011) ‘ফলে টেনশন-জাতীয় মাথাব্যথা ও মানসিক রোগগুলো নারীদের বেশি হয়। (Hammen, 2009) কমবয়েসী নারীদের হার্টের সমস্যাগুলো মূলত হার্টের ওপর এই স্ট্রেসের কারণেই হয়। (Vaccarino, 2014) লম্বা সময় নিয়ে স্ট্রেস থেকে IBS নামক অসুখ হতে পারে। পুরুষের চেয়ে নারীদের এই রোগের হার দ্বিগুণ। (Grundmann , 2010) স্ট্রেসের কারণে মুটিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা নারীদের অনেক বেশি পুরুষের চেয়ে। (Michopoulos, 2016) লাগাতার স্ট্রেসে থাকা নারীদের PMS এর সমস্যা বেশি মারাত্মক লেভেলের হয়। (Gollenberg, 2010)
[১১৬] ফলে সন্তানের ক্ষতি : [University of Missouri-Columbia. (2016, June 7). Stress exposure during pregnancy observed in mothers of children with autism : More research needed to understand gene-stress interaction. ScienceDaily.] গর্ভকালীন জটিলতা যেমন আগেই ব্যথা ওঠা, আগে আগেই বাচ্চা হয়ে যাওয়া, কম ওজনের বাচ্চা, প্রি-এক্লাম্পশিয়া, গর্ভকালীন ডায়বেটিস ইত্যাদি এখন বেশি হচ্ছে (Coussons-Read, 2013), বাচ্চাদের জন্মগত ত্রুটিও বেশি হচ্ছে, বাচ্চা হওয়ার পরও বাচ্চার সমস্যা রয়ে যাচ্ছে তার গর্ভকালীন স্ট্রেসের ফল হিসেবে। (Carmichael, 2007) অটিজম রোগাক্রান্ত শিশুও বেশি জন্মাচ্ছে। (Varcin, 2017)
——————–
ঠিক এই কথাটাই কোনো নারীবাদী শুনতে পছন্দ করে না। নারী-পুরুষের এই ‘জেন্ডার-রোল’-কে ইঙ্গিত করে এমন কোনো কথা, চাহে সেটা যত সত্যই হোক, যত কমনসেন্সই হোক। এই জেন্ডার-রোলকে ভুল প্রমাণ করার জন্য পুরো একটা ফ্যাকাল্টিই প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছে তারা। জেন্ডার স্টাডিজ। জেন্ডার স্টাডিজের কাজই হলো ‘গবেষণা করে’ জেন্ডার কনসেপ্টকে প্রমাণ করা,[১১৭] নারী-পুরুষের সর্বসমতা প্রতিষ্ঠিত করা।
‘এবার আসো শুধু নারীতে। নারীর দেহ, হরমোন-ব্যবস্থা, মস্তিষ্ক ম্যাপিং, মানসিক প্রক্রিয়া সকল কিছু এই কেন্দ্রীয় উদ্দেশ্যে বিবর্তিত। আমরা বলি না, বাচ্চা পালা-ই কি সব? বাচ্চা হওয়া ও পালাটা আমার নারী হওয়ার মূল উদ্দেশ্য, মূল ফাংশান। আমাকে ও আমার বাচ্চাকে ভরণপোষণ দেওয়া, আমাদেরকে শারীরিক-মানসিক স্ট্রেস থেকে রক্ষা করাটা পুরুষের উদ্দেশ্য ও ফাংশান। নইলে নারী-পুরুষ বিভাজন হওয়ার কী দরকার ছিল?’ সার্কেল কমপ্লিট। নতুন আলাপে প্রবেশ করে তিথি। হায় রে, সহজ চোখে দেখা সত্যটাও আজ মানুষকে বুঝিয়ে বলতে হয়।
‘কীভাবে ঘটে ব্যাপারটা? হরমোনের মাধ্যমে। দুই ধাপে—
এক. মায়ের পেটে।[১১৮] আর
দুই. বয়সন্ধিকালে এই পার্থক্যগুলো তৈরি হয়।
নারী হরমোন ইস্ট্রোজেনের প্রভাবে মেয়েরা হয়ে ওঠে নারী৷ পুরুষ হরমোন টেস্টোস্টেরোনের প্রভাবে ছেলেরা হয়ে ওঠে পুরুষ।
অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গের মতো ইস্ট্রোজেন ব্রেইনের ওপরও প্রভাব ফেলে।[১১৯] ব্রেইনেও এমন সব ফিচার তৈরি করে, যা নারীর মূল জৈবিক উদ্দেশ্য, আইমিন সন্তান-ধারণ ও লালন-পালনের জন্য স্পেশালাইজড।[১২০]
——————–
[১১৭] জেন্ডার শব্দটা কেবল ইংরেজি গ্রামারে লিঙ্গান্তর হিসেবেই জানত সবাই। নিউজিল্যান্ড নিবাসী আমেরিকান মনোবিদ জন মানি ১৯৭১ সালে দেন তাঁর বিখ্যাত ‘জেন্ডার থিওরি’। যেখানে জেন্ডার বলতে ‘লিঙ্গভিত্তিক সামাজিক ভূমিকা’ বুঝিয়েছেন তিনি। পুরুষের যে পুরুষলিঙ্গ, সেটাকে তিনি বললেন বায়োলজিক্যাল সেক্স। আর পুরুষ যা যা করে সেটাকে তিনি বললেন ‘জেন্ডার’। তার কথা হলো, মানুষ বায়োলজিক্যাল সেক্স নিয়ে জন্মায়; কিন্তু জেন্ডার সমাজ শেখায়। নবজাত শিশু থাকে সাদা শ্লেটের মতো (টেবুলা রাসা)। সমাজ তাকে পুরুষ বানায়৷ জনমানির এই থিওরি ৬০-এর দশকে ফেমিনিজমের ২য় ওয়েভকে তাত্ত্বিক পাটাতন এনে দেয়। ‘সমাজের দেওয়া’ জেন্ডার-রোলকে নারীবাদীরা অস্বীকার করে পুরুষের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। জন মানির থিওরির ওপর ভিত্তি করে একাডেমিয়ায় নতুন সাবজেক্ট তৈরি হয় : জেন্ডার স্টাডিজ। কিন্তু আসলেই জেন্ডার রোল সমাজ দেয়? নাকি জেন্ডার রোলের কোনো বায়োলজিক্যাল ভিত্তি আছে?
[১১৮] Endocrinology of the mammalian fetal testis. (O’Shaughnessy 2011, Ivell 2017)
[১১৯] ব্রেইন জুড়ে প্রচুর ইস্ট্রোজেন রিসেপ্টর ছড়িয়ে রয়েছে (Hara et al., 2015)। যা দ্বারা জরুরি সব প্রক্রিয়া সম্পাদিত হয় যেমন : জ্ঞান আহরণের প্রক্রিয়া বা ইন্দ্রিয়-ভাবনা-অভিজ্ঞতার আলোকে কিছু বুঝে নেওয়া (cognition), উদ্বেগ-টেনশন, দেহ-তাপমাত্রা, খাদ্যাভ্যাস, যৌন আচরণ (Do Rego et al., 2009)। এর প্রভাবে ব্রেইনের গঠন পরিবর্তন হয়ে যায় (Goldstein ২০০১) এবং সারা জীবনই ব্রেইন ও আচরণকে এই হরমোন নানাভাবে প্রভাবিত করতে থাকে (potent modulators of brain plasticity across the life-span) (Peperetal., 2011; Galeaetal., 2013)।
[১২০] রিসার্চ ইঙ্গিত করে যে, সেক্স হরমোন নারীদেহে ধারাবাহিক স্নায়ু প্রক্রিয়া (neurogenic cascade) স্টিমুলেট করে যা বাড়িয়ে তোলে neurite outgrowth (Minano et al.,2008), mitochondrial and synaptic health (Hara et al.,2014), dendritic branching (Hao et al.,2006) এবং myelination (Patel et al., 2013)। ফলে ব্রেইনের গঠন ও কার্যক্রমে পার্থক্য হয়।
——————–
অন্যান্য মেয়েজন্তুর চেয়ে মেয়েমানুষকে আরও বেশি ফিচার দিতে হবে। জন্তু-জানোয়ারের বাচ্চা হয়েই দৌড় দেয়। আর মানুষের বাচ্চা? কত দুর্বল, কত অসহায় থাকে ৩-৪ বছর পর্যন্ত, তাই না? তাই তার আরও বেশি দরকার মা-কে। ক্যাঙ্গারু ইত্যাদি মারসুপিয়াল প্রাণীদের বাচ্চা অপরিণত হয়ে তৈরি হয়। এজন্য থলে দেওয়া থাকে মায়ের পেটে। মানুষও কাছাকাছি। হাঁটা-দৌড়ানো-মনের ভাব প্রকাশে দেরি হয়। এজন্য মেয়েমানুষকে মানসিকভাবেও বিশেষভাবে তৈরি করতে হবে বা বিবর্তিত হতে হবে; যাতে এই সাপোর্টটা দিতে পারে। এখন তোমাকে বলব, কী সেই মানসিক যোগ্যতাগুলো—যা নারীকে দেওয়া হয়েছে কেন্দ্রীয় উদ্দেশ্য পূরণে।’
মিনু ভাবছে, ভাবী যা যা বলল, একটা কথাও তো আমাদের চেনাশোনা দুনিয়ার বাইরের না; কিন্তু আমি মানতে পারছি না কেন? ভেতরে বসে থাকা কেউ একজন মেনে নিতে বাধা দিচ্ছে। গলার কাছে কিছু একটা আটকে ধরে রেখেছে। কী এটা? শিক্ষা? কী সেই শিক্ষা—যা আমার চোখের স্বাভাবিক দেখাকে, মনের স্বাভাবিক বয়ে চলাকে অস্বীকার করতে শেখায়। মানবদেহ, চাঁদ-সুরুজ-তারা দেখে মানুষের সার্বজনীন অনুভব : এই আশ্চর্য শৃঙ্খলা ও জটিলতা কেউ তো বানিয়েছেন। চোখ ও মনের এই স্বাভাবিক সম্পর্ককে হাজারও কৃত্রিম কল্পিত থিওরির বেড়াজালে কে আটকে দেয়? কোন সে শিক্ষা, যা আমার ফিতরাতকে, আমার নিয়ে-আসা জ্ঞানপ্রক্রিয়াকে নষ্ট করে দেয়।
‘জানো মিনু, রিসার্চে কী এসেছে।
- কিছু মৃগী রোগীর ব্রেইনের অংশ সরিয়ে ফেলা হয়েছে অপারেশন করে, যেখান দিয়ে কথা বলাও নিয়ন্ত্রণ হয়৷ আশ্চর্য ব্যাপার হলো : পুরুষ রোগীর বাকশক্তি চলে গেছে, কিন্তু নারী রোগীর বাকশক্তি ঠিক আছে।[১২১] মানে বাকশক্তির জন্য নারী ওই একটা অংশের ওপরই নির্ভরশীল না। অন্যান্য অংশ দিয়েও কাজ চালিয়ে নিতে পারে।
- একটা সমস্যা সমাধানের সময় পুরুষের মগজের একটা জায়গা এক্টিভ, স্ক্রিনে উজ্জ্বল। নারীদের মগজের নানা জায়গা এক্টিভ।[১২২]
——————–
[১২১] McGlone 1978; Trenerry et al.1995
[১২২] Shaywitz et al. 1995; Pugh et al. 1996; Jaeger et al. 1998; Clements et al. 2006, Chen et al. 2007 পরবর্তী সময়ে ২০১৪ সালে University of Pennsylvania-র গবেষকরা ৪২৮ জন যুবক ও ৫২১ জন যুবতীর ব্রেইন ইমেজিং করেন। বার বার পাওয়া যায়, নারীদের ব্রেইনের দুইপাশের সমন্বিত এক্টিভিটি খুবই শক্তিশালী। বিপরীতে পুরুষেরটা একটা অংশের ভেতরে শক্তিশালী।
——————–
অর্থাৎ একটা কাজের জন্য পুরুষের মগজে একটা নির্দিষ্ট জায়গা এক্টিভ হয়। মানে, নির্দিষ্ট জায়গা দিয়ে নির্দিষ্ট কাজ করে; কিন্তু নারীর মগজে ব্যাপারটা এত কাট-কাট না, একটা কাজে ব্রেইনের নানান জায়গা একসাথে অংশ নেয়। তাই পুরুষের জবান চলে গেলেও নারীরটা ঠিক আছে। শুনছ মিনু?
‘জি ভাবী, বলো’। আশ্বস্ত হয়ে তিথি বলে চলে…
‘নারীর রয়েছে :
- ব্রেনের দুপাশের মাঝে অধিক কানেকশন।[১২৩] ফলে নারীর ইন্ট্যুইশন পাওয়ার আছে। না-বলা কথা বুঝে ফেলা, না-দেখা জিনিস আঁচ করার ক্ষমতা। সন্তানের আশু বিপদ, সন্তানের নন-ভার্বাল কমিউনিকেশন বোঝা, কান্নার অর্থ বোঝার জন্য এই ক্ষমতা এসেছে।
- নারীর কথা বলার ক্ষমতা বা নিজেকে প্রকাশের ক্ষমতা অনেক বেশি।[১২৪] শিশুর ব্যক্তিত্ব ও ভাষার বিকাশে এটা জরুরি। পুরুষ নিজেকে প্রকাশ করতে পারে কম। ভালো বুঝবা আরও। নারী কাঁদতে পারে, পুরুষ পারে কম।
- নারীর অক্সিটোসিন হরমোন বন্ধন তৈরি করে।[১২৫] এজন্য নারীর সহমর্মিতা, সহানুভূতি, সম্পর্ক গড়া, টিকিয়ে রাখার ইচ্ছা অনেক বেশি। শিশুর জন্য মায়ের বিকল্প হতে পারে না। পুরুষের টেস্টোস্টেরোন বাচ্চা-পালার বিরোধী।[১২৬]
——————–
[১২৩] Ingalhalikar M, Smith A, Parker D, et al. : Sex differences in the structural connectome of the human brain. Proc Natl Acad Sci U S A. 2014;111(2):823–8.
[১২৪] Kurth F, Jancke L, Luders E : Sexual dimorphism of Broca’s region : More gray matter in female brains in Brodmann areas 44 and 45. J Neurosci Res. 2017;95(1–2):626–32.
[১২৫] মা-শিশু, স্বামী-স্ত্রী, ইয়ার-দোস্ত ইত্যাদি সকল যুগল বন্ধনের জন্য দায়ী এই হরমোন। আদর করে একে ডাকা হয় bonding hormone, cuddle hormone (জড়িয়ে ধরা) কিংবা love hormone. যৌনমিলন, লিঙ্গোত্থান, বীর্যপাত, গর্ভধারণ, প্রসব, বুকের দুধ তৈরি, মাতৃত্বের অনুভূতি, সামাজিক বন্ধন, স্ট্রেস দূরীকরণ এবং আরও বিভিন্ন কাজে এই হরমোন অংশ নেয়। (Magon et al. 2011))
[১২৬] ২০০৫-২০০৯ সালের মাঝে ৪৬৫ জন পুরুষের ওপর গবেষণা হয়। দেখা গেছে পুরুষের সন্তান প্রতিপালনের সাথে টেস্টোস্টেরোন ৩০% কমে যাওয়ার সম্পর্ক রয়েছে। ২০১৬ সালে ১৭৫ জন পুরুষের ওপর আরেকটি রিসার্চে (Kuo et al. 2016) এসেছে, সন্তানের কান্নার প্রতি পুরুষের রেসপন্স কেমন হবে, তা টেস্টোস্টেরোনের লেভেলের সাথে সম্পর্কিত। যাদের হরমোন বেশি তারা বাচ্চার কান্নাকে মনে করেছে বিরক্তিকর, আমার দ্বারা একে থামানো সম্ভব না। যাদের হরমোন কম তারা বেশি সেন্সিটিভ বাবা প্রমাণ হয়েছে। ANN ARBOR (October 29, 2015), Low testosterone, men’s empathy can determine parenting skills, Michigan News, University of Michigan.
——————–
- পুরুষ শিশুর টান বস্তুর প্রতি… অবজেক্ট। নারীশিশুর টান চেহারার প্রতি।[১২৭] হাসি দেওয়া, কথা বলা এই সামাজিক ব্যাপারগুলো নারীশিশুর আগে আসে পুরুষের চেয়ে।
- কাজের সময় পুরুষ থাকে ফোকাসড। পুরুষ যা করে, খোপ খোপ ব্রেইন[১২৮] বলে ডিফোকাস হয় কম। নারী মাল্টিটাস্কিং-এ পারদর্শী,[১২৯] যা সন্তান লালনের জন্য জরুরি। এটা হতে গিয়ে আবার আরেক দিকে সমস্যা। মাল্টিটাস্কিং-এর জন্য ব্রেইনের বিভিন্ন কাজের স্থান ওভারল্যাপিং বলে, ডিফোকাস হয়ে যায় সহজে।[১৩০][ক]
- যখন দেখে অনেক ডিটেইলস দেখে, আপাত নিষ্প্রয়োজন জিনিসও দেখে এবং মনে রাখে।[১৩১] পুরুষ স্থানের বিবরণ মনে রাখে বেশি (spatial memory)। নারী মনে রাখে বেশি কথাবার্তা (verbal memory)[খ]
- ফলে দ্বিধা, কনফিউশন পুরুষের চেয়ে বেশি৷[১৩২] এবং এটাই নারীর শক্তি। সন্তানের বিপদের সামান্যতম আভাসও সে ধরবে, জরুরত না থাকলেও সতর্ক হবে, সন্তানকে আগলে নেবে। দ্বিধা কাজে লাগিয়ে সে পুরুষকে অনেক সাজেশন দিতে পারবে। [গ]
——————–
[১২৭] ১০২ জন নবজাতকের ওপর রিসার্চে এটা এসেছে (Connellan et al. 2000)। ৬ মাস বয়সী বাচ্চাদের ক্ষেত্রেও একই ফল এসেছে (Alexander et al. 2009)
[১২৮] কার্যগতভাবে compartmentalized ও specialized. নির্দিষ্ট স্থানই কেবল নির্দিষ্ট কাজে অংশ নেয়। মানে দেখতে পার্টিশন দেয়া নয় কিন্তু।
[১২৯] Stoet, G., O’Connor, D.B., Conner, M. et al. Are women better than men at multi-tasking?. BMC Psychol 1, 18 (2013).
[১৩০] রিসার্চে এসেছে, নারীরা মূল কাজের বাইরের খুঁটিনাটি দিয়ে (task-irrelevant spatial information) ডিফোকাস হয় ছেলেদের চেয়ে বেশি। একে বলা হচ্ছে ‘সাইমন ইফেক্ট’। (Stoet 2017) নারী-পুরুষে মৌলিক পার্থক্য নেই, এটা প্রমাণ করার চেষ্টা করলেও বহুল আলোচিত আরেক রিসার্চে (Riley et al., 2016) ফাঁকতাল দিয়ে যা বেরিয়ে গেছে তা হলো : Sustained Attentional Control টেস্টে নারীরা Omission error বেশি করে, পুরুষেরা বেশি করে Commission error. মানে পুরুষ রেসপন্স করেছে কিন্তু ভুল করেছে, মানে এটেন্ড করেছে। আর Omission error হলো এটেন্ডই করেনি, মনোযোগই দেয়নি, ডিফোকাস ছিল বলে।
[১৩১] Beeman and Bowden, 2000; Fink et al., 1996, 1999. Cahill and van Stegeren, 2003, 2004; Kilpatrick et al., 2006.
[১৩২] ইস্ট্রোজেন হরমোন এই দ্বিধার (inhibition of prepotent responses) জন্য দায়ী। ইস্ট্রজেন হরমোন যত বেশি, নারী তত বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে স্থিতিশীলতা থেকে নমনীয় হতে থাকে (women are biased towards cognitive flexibility rather than cognitive stability)। (Stoet 2017)
——————–
- তারপর যেমন ধরো, নারী পুরুষের চেয়ে আবেগতাড়িত।[১৩৩] নারীর মস্তিষ্কের ফাংশন ওভারল্যাপিং বলে আবেগ ও যুক্তি আলাদা করে বুঝতে পারে কম। একটা সিদ্ধান্ত নিচ্ছি, সেটা আবেগ থেকে নিলাম নাকি যুক্তি থেকে নিলাম, কখন আবেগ যুক্তিকে পরাস্ত করে আপারহ্যান্ড নিয়ে নিল, এই পার্থক্য নারী কম করতে পারে৷ পুরুষের আবেগের জায়গা আলাদা, যুক্তির জায়গা আলাদা।[ঘ]
- আমরা সহজে প্রভাবিত হই, সহযোগিতা করে, মেনে নেয়, রিসেপ্টিভ।[১৩৪] পুরুষের টেস্টোস্টেরোন প্রভাব নেয় না, বিদ্রোহ করে। মেইল ইগো তৈরি করে।[১৩৫][ঙ]
——————–
[১৩৩] সাধারণভাবে নারী বেশি আবেগপ্রবণ (impulsive) পুরুষের চেয়ে। Barratt Impulsivity Scale-এ ২৭-৫১ বছরের নারীদের আবেগ একই বয়সী পুরুষের চেয়ে বেশি। (Marazziti et al., 2010)
[১৩৪] অক্সিটোসিন হরমোনের প্রভাবে। এর নর্মাল লেভেল 1.25–5 pg/mL. মেয়েদের ডিম্বপাতের সময় 5–10 ng/mL মানে দ্বিগুণ হয়ে যায়। (Appendix, Molina ২০১৩) আর পুরুষে থাকে রেঞ্জের নিচের দিকে 1.53 ± 1.18, মেয়েদের থাকে উপরের দিকে 4.53 ± 1.18। (Marazziti ২০১৯)
[১৩৫] University College London এর গবেষকরা খুব ইন্টারেস্টিং একটা রিসার্চ করেন মেয়েদের ওপর। ৩৪ জন নারীকে জোড়া জোড়া করে দিয়ে কিছু কাজ দেওয়া হয় তাদের সহযোগিতার মনোভাব বুঝতে। তাদেরকে টেস্টোস্টেরোন সাপ্লিমেন্ট দেওয়া হয়। যেদিন দেওয়া হয়নি সেদিন তাদের সহযোগিতার মনোভাব ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু যেদিন টেস্টোস্টেরোন দেওয়া হয়েছে, সেদিন তারা অসহযোগিতা দেখিয়েছে, সঙ্গীর চেয়ে নিজের সিদ্ধান্তেই অটল থেকেছে, ইগো প্রদর্শন করেছে (egocentrically)। (Tajima-Pozo ২০১৫)
——————–
ভুল বুইঝো না, মিনু। এগুলো কিন্তু কোনোভাবেই নারীর দুর্বলতা নয়; বরং এগুলোই নারীর শক্তি। নারীর নারীত্বের শক্তি।’ মুড়িগুলো মিনু একাই খেয়ে যাচ্ছে। অবশ্য তিথি নিজে খাওয়ার জন্য আনেওনি। এনেছেই ওকে এনগেজ রেখে কথাগুলো শোনানোর জন্য। অনেকগুলো কথা বলে ফেলেছে তিথি। ওকে ভাবার সময়টাও দেওয়া দরকার। মিনুকে সময় দিতে তিথি একমুঠো মুড়ি তুলে নিল।
‘আচ্ছা ভাবী, বুঝলাম; কিন্তু প্রশ্ন হলো—এত পার্থক্যই যদি থাকে, তাহলে এই ‘সমান সমান’ ব্যাপারটা এলো কোত্থেকে? সরকারি পলিসিতে পর্যন্ত জেন্ডার-সমতা। কাহিনি কী?’ মানে মিনু আলোচনায় এনগেইজ করছে। এটা ভালো একটা লক্ষণ। কাউকে আলোচনায় ধরে রাখার জন্য তাকে প্রশ্ন করতে হবে, বোঝার সময় দিতে হবে। টু-ওয়ে ডিসকাশন।
‘সে এক বিরাট ইতিহাস, মিনু। তোমাকে আমি গত বছর একটা বই দিয়েছিলাম। নীলরঙা। ডাবল স্ট্যান্ডার্ড ২.০ নামটা বইয়ের। পড়োনি বোধহয়। পইড়ো সময় করে, অনেক প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবে। আসলে ১৭৬০ সালের পরে ইউরোপ থেকে যে শিল্পবিপ্লবের শুরু হয়, তার একটা বৈশিষ্ট্য ছিল যন্ত্রবিপ্লব। পেশীশক্তি আর তেমন একটা প্রয়োজন রইল না। যন্ত্রের দ্বারা উৎপাদনের ফলে যে উৎপাদন আগে পুরুষের শ্রম ছাড়া হতো না, সেই কাজ নারীর সুইচ চাপার দ্বারাই সম্ভব হলো। দ্বিতীয়ত, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ইউরোপ-আমেরিকার পুঁজিবাদী-ব্যবস্থা এবং সোভিয়েতের সমাজতান্ত্রিক-ব্যবস্থার মাঝে স্নায়ুযুদ্ধ শুরু হয়। প্রভাব বিস্তারের যুদ্ধ-যুদ্ধ ভাব। উৎপাদন বাড়াতে নারীকে গণহারে শ্রমবাজারে বের করে আনার দরকার পড়ে। মূলত ক্ষমতায়ন, সমতা, স্বাধীনতা, জেন্ডার-রোল অস্বীকার—এসব এই যুগের নির্মিত বয়ান; যাতে ঘর ছেড়ে নারীরা গণহারে উৎপাদনকর্মে যোগ দেয়।
মজার একটা ঘটনা বলি তোমাকে, মিনু। ১৯৭২ সালে আমেরিকায় সমানাধিকার আইন (ERA) প্রস্তাব করে রাজ্য সংসদগুলোয় পাঠানো হয় অনুমোদনের জন্য। স্রোতের বিপরীতে অবস্থান নেন গুটিকয়েক আমেরিকান নারী। আইনজীবী Phyllis Schlafly (1924-2016), লুইজিয়ানার এমপি Louise Johnson. আমেরিকান নারীদের নিয়ে তারা শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে তোলে। যেসব পুরুষ সাংসদেরা বিপক্ষে ছিল, তারা জানিয়েছে : তারা বিপক্ষে; কারণ, তাদের স্ত্রীরা এর বিপক্ষে। লিবারেল ও নারীবাদীদের চেষ্টায় অধিকাংশ রাজ্য অনুমোদন দিয়ে দেয়। আর ৩টা রাজ্যের অনুমোদন দরকার ছিল। এ অবস্থাতেই ১৯৮২ সালে ERA-র ডেডলাইন শেষ হয়ে যায়। আমেরিকান নারীরাই এর বিরোধিতা করে একে ব্যর্থ করে দেয়।[১৩৬]
——————–
[১৩৬] যদিও তাতে খুব বেশি লাভ হয়নি।
——————–
‘ও মা, কেন?’
‘কারণ, তারা ধরতে পেরেছিলেন—এর ফলে নারীরাই সমস্যায় পড়বে। নারীরা যে সুবিধা স্বামীদের থেকে সামাজিক-ধর্মীয়ভাবে আবশ্যক হিসেবে পেয়ে আসছিল, তা আর পাবে না। ঘরের বাইরে থাকতে, শ্রমবাজারে আসতে, চাকরি করতে নারীদেরকে বাধ্য করা হবে। ১৮ বছর হলেই বাধ্যতামূলক সামরিক সার্ভিসে মেয়েদের যোগ দিতে হবে (যেমন ইসরাইল)। অনেকের মতে, এই সমানাধিকার দ্বারা পতিতা, লেসবিয়ান আর গে ছাড়া আর কেউ বেনিফিট পাবে না। এই ‘সমতা’ ঠিক সাধারণ ডিকশনারি অর্থে সমতা না, এই সমতা একটা বিশেষ দর্শন, যার জন্ম পুঁজিবাদের পেটে, তাদের মুনাফার উদ্দেশ্যে।’ তিথির আলাপের মাঝে নাটকীয়তা আছে। তাই লম্বা সময় শুনতে বিরক্ত লাগে না একদম।
‘আচ্ছা, পড়ে দেখবোনে তোমার বই। কী যেন বলছিলে? এইসব দুর্বলতার জন্যই আমাদের সাক্ষ্যের দাম অর্ধেক?’
‘না না মিনু, দুর্বলতা কেন বলছ? এগুলোই নারীর বিশেষায়িত শক্তি। নারীত্বের শক্তি। নারীর হরমোন-প্রভাবিত কিছু ফিচার রয়েছে, যা সন্তানধারণ, সন্তানপালন, পূর্বাভাস অনুমান, পরামর্শক হিসেবে বৈচিত্র্যময় দ্বিধা-শঙ্কার জন্য দিতেই হয়েছে। বা ওই হরমোনের দরুন ফিচারগুলো মাস্ট হয়ে পড়েছে। এই বৈশিষ্ট্যগুলোই নারীর শক্তি। যেমন গাইনী ডাক্তার হার্টের অপারেশন পারে না, এটা কি তার শক্তি না দুর্বলতা? এটা তার দুর্বলতা না; বরং এটাই তার শক্তি যে তিনি গাইনী অপারেশন ভালো পারেন। যেগুলো নারীর শক্তি, সেগুলোই আরেক দিকে গিয়ে দুর্বলতা। নারীর স্পেশালাইজড ফিচারগুলো আবার সিদ্ধান্তগ্রহণ, প্রতিযোগিতা, স্ট্রেস নেওয়ার ক্ষেত্রে একপ্রকার দুর্বলতা। যে দুর্বলতাগুলো আবার পূরণ করবে একজন পুরুষ। একইভাবে পুরুষেরও কিছু দুর্বলতা আছে, যেগুলো পূরণ করে তাকে ভালো রাখতে লাগবে একজন নারী। এভাবেই আমরা তৈরিই বলো, আর বিবর্তিতই বলো। পরিপূরক।’
‘এই ফিচারগুলো কি সাক্ষ্যগ্রহণের ক্ষেত্রেও দুর্বলতা?’ খচখচে ভাব মিনুর।
‘হ্যাঁ, এই তো বুঝতে পেরেছ। শুধু মামলায় সাক্ষ্যের জন্য। বিস্তারিত বলছি। আমাদের আগের আলোচনার সাথে কানেক্ট করে করে বোঝো, মিনু—
[ক] নারী সহজে প্রভাবিত হয়। বাদী বা বিবাদী দ্বারা নারীকে প্রভাবিত করা পুরুষকে প্রভাবিত করার চেয়ে সহজ। আরেক নারীর সাক্ষ্য যুক্ত হয়ে প্রভাবিত হওয়ার সম্ভাবনা দূর করা হলো।
[খ] নারীর মেমোরি খুঁটিনাটি অপ্রয়োজনীয় ডিটেইলস সহকারে। তাছাড়া মাসিক রজঃচক্রে ৯০% নারী আবেগিক সমস্যায় ভুগে থাকেন।[১৩৭] সুতরাং সে সময়কার সিদ্ধান্ত এবং সুস্থ সময়ের সিদ্ধান্ত এক হয় না। বিশেষ করে স্মৃতি সংরক্ষণ।[১৩৮] আবেগ বা পরিস্থিতিগত স্ট্রেসে মেয়েদের ১০% বেশি সময় লেগেছে কোনো কিছু মনে করতে। (Schwabe & Wolf, 2010). আরেকজন নারীর সাক্ষ্য যোগ হলে এই দুর্বলতা কাটল।[১৩৯]
——————–
[১৩৭] Milad, M. R., Zeidan, M. A., Contero, A., Pitman, R. K., Klibanski, A., Rauch, S. L., et al. (2010). The influence of gonadal hormones on conditioned fear extinction in healthy humans. Neuroscience, 168, 652–658.
[১৩৮] আমাদের রিসার্চ সাজেস্ট করে, মাসিকের চক্রে ব্রেইনের নিজস্ব কার্যক্রম ও যোগাযোগব্যবস্থায় যথেষ্ট প্রভাব পড়ে। বিশেষ করে, হিপোক্যাম্পাস অংশটা যে জায়গাটা কোনো প্রসঙ্গে রক্ষিত স্মৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করে (contextual memory-regulation)। মাসিকচক্রে প্রোজেস্টেরোন হরমোনের কারণে ব্রেইনের বিভিন্ন অংশের সংযোগে পরিবর্তন আসে (bilateral DLPFC and sensorimotor cortex) যা আবেগ ও ব্যথার অনুভূতিতে কাজ করে। (Arélin, ২০১৫)
[১৩৯] সূরা বাকারা ২৮২ নং আয়াতের ব্যাখ্যায় ইবনু কাসির রাহিমাহুল্লাহ বলেন : এর মানে—একজন নারী যদি সাক্ষ্য ভুলে যায়, আরেকজন যেন তাকে মনে করিয়ে দিতে পারে, ঘটনা স্মরণ করিয়ে দিতে পারে। (তাফসিরু ইবনি কাসির, খণ্ড : ১, পৃষ্ঠা : ৭২৪) ঘটনার স্মরণ নিশ্চিত করার জন্য আল্লাহ দুইজন নারীর সাক্ষ্যের কথা বলেছেন। কেননা, মন ও স্মৃতির ক্ষেত্রে দুজন নারীর সমকক্ষ একজন পুরুষ। (ইলামুল মুওয়াক্কিয়িন, খণ্ড : ১, পৃষ্ঠা : ৭৫) এখানে নারীকে ছোটো ও তুচ্ছ সাব্যস্ত করা উদ্দেশ্য নয়। (যেমন, অনেকে বুঝাতে চেষ্টা করে।) বরং উদ্দেশ্য হলো, একটি প্রাকৃতিক দুর্বলতার কথা বর্ণনা করা; যা মহান আল্লাহর ইচ্ছা এবং তাঁর কৌশলগত ব্যাপারের অন্তর্ভুক্ত। [তাফসিরু আহসানিল বায়ান]
——————–
[গ] নারীর সিদ্ধান্তে বা সাক্ষ্যে কাজ করে স্বভাবসুলভ দ্বিধা বা কনফিউশন৷ এটা নাকি ওটা। আরেকজন নারীর সহায়তা তার সাক্ষ্যকে বোল্ড করে।
[ঘ] যুক্তি ও আবেগের সীমা টের পায় পুরুষের চেয়ে কম। আরেকজন নারীর যুক্তি সংযোজন সাক্ষ্যে আবেগের প্রভাব হ্রাস করল। [১৪০]
এই যে দুর্বলতা কাটিয়ে সাক্ষ্যকে শক্তিশালী করা, এটা শুধু মামলা-মোকদ্দমা ও ঈদের চাঁদ দেখার মতো সেন্সিটিভ ক্ষেত্রে।[১৪১] যেখানে সাক্ষ্যপ্রমাণে গরমিলের কারণে একটু থেকে একটু হলে অপরাধী ছাড়া পেয়ে যেতে পারে, মজলুম হতে পারে জালিম, আর অপরাধী হতে পারে নিরপরাধ। অন্যান্য ক্ষেত্রে যেখানে এই সম্ভাবনা নেই। যেমন—
- নারী যখন বাদী, তখন তার একার অভিযোগই আমলে নেওয়া হবে।[১৪২] সাক্ষী হিসেবে ২ নারীসাক্ষী। বাদী হিসেবে না। বাদী তো একলাই অভিযোগ দায়েরে যথেষ্ট।
- আবার হাদিস বর্ণনায়ও একজন নারীর সনদ যথেষ্ট।[১৪৩] এই সাক্ষ্যে দুইজনের দরকার নেই।
——————–
[১৪০] তারা (নারীরা) বললেন, হে আল্লাহর রাসুল, আমাদের যুক্তিবোধ (আকল) ও দ্বীনি আমলের ঘাটতি (نَاقِصَاتِ عَقْلٍ وَدِينٍ) কী? তিনি বললেন, ‘নারীদের সাক্ষী কি পুরুষদের সাক্ষীর অর্ধেক নয়?’ তারা বললেন—‘জি, হ্যাঁ।’ তিনি বললেন—‘এটিই তাদের যুক্তিবোধের ঘাটতি। যখন তাদের মাসিক শুরু হয় তখন কি তারা সালাত ও সাওম (রোজা) বাদ দেয় না?’ তারা বললেন, ‘জি, হ্যাঁ।’ তিনি বললেন—‘এটিই তাদের দ্বীনে কমতি।’ [সহিহ বুখারি : ৩০৪]
[১৪১] তবে নারীদের সাথে সম্পর্কিত কিছু ক্ষেত্র আছে, যেসব জায়গায় একজন নারীর সাক্ষ্যই যথেষ্ট। যেমন—শিশুদের দুধপান সম্পর্কিত বিষয়াদি। যেসব কারণে বিবাহ ত্রুটিগ্রস্ত হয় ইত্যাদি।
[১৪২] ইবনে আরাবি, আহকামুল কুরআন ৪/২৮৩, মুহাযযাব ৩/৪৫২ [১৪৩] তাদরীবুর রাবী ১/৩৩২ (যদিও সাক্ষ্য ও রিওয়ায়াতের মধ্যে মুহাদ্দিসগণ কিছুটা পার্থক্য করেছেন)
——————–
আল্লাহ নারীর বায়োলজি নারীর সাইকোলজি আমলে নিয়েই এটা করেছেন। তুমি আমি দেখি পুঁজিবাদের চোখে, পাঠ্যপুস্তকের চোখে; কিন্তু আল্লাহ তো নিজেই স্রষ্টা, আমাদের দেহের স্রষ্টা, মনের স্রষ্টা। বোঝা গেল হে, আমার সবেধন ননদিনী?’ তিথির ওপর থেকে যেন একটা ভার নেমে গেল। দায়িত্বের ভার। ভাবী হিসেবে ওর দায়িত্ব ছিল ননদকে এটুকু বোঝানো। অনেক দিন থেকেই তক্কে তক্কে ছিল। আজ সবটা ওকে বলা গেল। এভাবে আমাদের প্রত্যেকের ওপর মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহর নিয়ে আসা দ্বীন পৌঁছে দেওয়ার ওজন চেপে আছে। প্রত্যেকের ওপর। ওজনের ভার টের পাওয়া যায়?
‘আমাদের পুরো আলাপটা সামারাইজ করি যদি, মিনু। বংশরক্ষার জন্য নারীকে যে বৈশিষ্ট্য ও স্বভাব দিতে হয়েছে (বেস্ট ডিজাইন হিসেবে), সেই নারীসুলভ সহজাত স্বভাবের দরুন কোনো নিরপরাধ যেন মজলুম না হয়, অপরাধী যেন বেঁচে না যায়। সেজন্য আরেক নারীর সাক্ষ্য দ্বারা নারীর সাক্ষ্যকে শক্তিশালী করা হয়েছে। তার একক সাক্ষ্যের দুর্বলতা কাটানো হয়েছে। ব্যস।’
ভেজা চুলে আঙুল চালাতে চালাতে মিনু বলে—”আচ্ছা, ধরে নাও বুঝেছি। এবার বলো, নারী সম্পত্তিতে পুরুষের অর্ধেক কেন?’
‘সিম্পল। কেননা, পুরুষ ভরণপোষণে খরচ করতে ধর্মীয়ভাবে বাধ্য। আমার খরচ দেওয়া স্বামীর ওপর ধর্মীয় আবশ্যিক দায়িত্ব। এমনকি দুজন আয় করলেও, আমি আমার ইনকাম সংসারে দিতে বাধ্য নই। বিপরীতে নিজের আয় সংসারে দেওয়া আমার স্বামীর ওপর ওয়াজিব। আমাকে ভরণপোষণ না দিলে ইসলামি আদালত তার থেকে সমপরিমাণ আদায় করে আমাকে দেবে।[১৪৪] আমি যদি সংসারে দিই, সেটা আমার অনুগ্রহ। স্বামী দাবিও করতে পারবে না, জেরাও করতে পারবে না। ইসলামের বিধান এটাই।[১৪৫] এখন, কেন পুরুষের ওপর কামাই করা এবং পরিবারের ওপর খরচ করা ওয়াজিব, নারীর ওপর না। বোঝা গেছে তো? নাকি আবার বলব?’
——————–
[১৪৪] নাবালেগ সন্তানের খোরপোষ পিতার একক দায়িত্ব, এতে অন্য কেউ তার অংশীদার হবে না। যেমন—স্ত্রীর খোরপোশে কেউ তার অংশীদার হয় না। [হিদায়া, ইফাবা, খণ্ড : ২, পৃষ্ঠা : ২৩৮] ইমাম কুদুরি রাহিমাহুল্লাহ বলেন— স্বামীর ওপর স্ত্রীর ভরণপোষণ ওয়াজিব। স্ত্রী যখন নিজেকে স্বামীগৃহে সমর্পণ করবে, তখন স্বামীর ওপর স্ত্রীর খোরপোষ ও বাসস্থানের ব্যবস্থা করা আবশ্যক হবে। তবে কী-রকম খোরপোষ ওয়াজিব, এ ব্যাপারে উভয়ের অবস্থা বিবেচনা করা হবে। ইমাম খাসসাফের মতে, উভয়ই সচ্ছল হলে সচ্ছলতাপূর্ণ খোরপোষ ওয়াজিব, উভয়ে অসচ্ছল হলে অসচ্ছলতা অনুযায়ী খোরপোষ ওয়াজিব। আর স্ত্রী সচ্ছল স্বামী অসচ্ছল হলে, তার খোরপোষ হবে সচ্ছলের চেয়ে কম, অসচ্ছলের চেয়ে বেশি, এমন পরিমাণের। ইমাম শাফিয়ি ও ইমাম কারখি রাহিমাহুমুল্লাহর মতে—শুধু স্বামীর অবস্থা বিবেচনা করা হবে। [হিদায়া, ইফাবা, খণ্ড : ২, পৃষ্ঠা : ২২৬]
[১৪৫] ফাতাওয়া তাতারখানিয়া, খণ্ড : ১৪, পৃষ্ঠা : ৪১৩
——————–
‘না না, বুঝেছি’।[১৪৬]
‘সমতা মানেই কিন্তু ন্যায় না। সমতাও জুলুম হতে পারে। দেখো, পুরুষকে খরচে বাধ্য করলাম, নারীকে করলাম না। আবার দেওয়ার সময় সমান দিলাম। তাহলে পুরুষের ওপর জুলুম হইল না?’
‘হুমমম’।
‘এজন্যই ইসলাম পুরুষকে দ্বিগুণ দিয়েছে। পুরুষ নিজে চলবে, স্ত্রীকে চালাবে, বাপ-মাকে চালাবে, সন্তানগুলোকে চালাবে। আত্মীয়-স্বজন থাকলে তাকেও চালাবে; যেমন—পুত্রহীন চাচা, যার সে ওয়ারিশ। আর নারী কাউকেই চালাবে না, নিজেকেও না। নিজের খরচও স্বামী থেকে নেবে। নিজের টাকা নিজের খুশিমতো খরচ করবে। সংসারে কোনোরকম খরচ করতে নারী বাধ্য না। তাই নারীর জন্য অর্ধেকই যথেষ্ট ও ন্যায্য।
আবার নারী যে সব সময় পুরুষের অর্ধেকই পায়, তা কিন্তু না। মাত্র ৪ সিনারিওতে অর্ধেক পায়। ১০ সিনারিওতে নারী পুরুষের সমানও পায়, কখনো বেশিও পায়। আবার কিছু ক্ষেত্রে পুরুষ পায় না, নারীই পায়।[১৪৭] আমার ডায়েরিতে সিনারিওগুলো লেখা আছে, দেখাবোনে তোমাকে।’
‘দিয়ো তো। নতুন জিনিস শুনলাম। এতদিন তো শুনে এসেছি, নারী সম্পত্তিতে সবসময়ই অর্ধেক পায়। সম্পত্তিতে নারীর সমানাধিকারের দাবিতে মিডিয়া-এনজিও-নারী সংগঠনগুলো সোচ্চার।[১৪৮] তুমি আবার এ কী শোনালে?’
——————–
[১৪৬] বেশী শক্তি, প্রতিকূল পরিবেশে বেশি কর্মদক্ষতা ও বাধাহীন কর্ম-ধারাবাহিকতার কারণে শারীরিকভাবেই অ্যাডভান্টেজ পায় পুরুষ। বিশেষ বিশেষ সময়ে; যেমন—পিরিয়ডের সময়, প্রেগন্যান্সির সময়, মেনোপজের পর নারীর কর্মদক্ষতা, মানসিক দক্ষতা হ্রাস পায়; পরনির্ভরশীলতা এসে পড়ে। স্বাভাবিকভাবেই, যেটা পুরুষের আসে না। লাগাতার স্ট্রেস নেওয়ার জন্যই পুরুষের শরীর ও শরীরী প্রক্রিয়াগুলো তৈরি। বিপরীতে নারী শরীর স্ট্রেসের জন্য কম উপযুক্ত। টীকা ১১৫ দ্রষ্টব্য।
[১৪৭] কুরআনের ভাষ্য অনুযায়ী বিধানটি শুধু ছেলে-মেয়ে এবং ভাই-বোনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। অথচ নারী বলতে শুধু মেয়েসন্তান বা বোনদের বোঝায় না। এরা ছাড়াও অনেক নারী ওয়ারিস রয়েছে; যাদের বিপরীতে পুরুষের দ্বিগুণ পাওয়ার বিধান নেই। মাত্র ৪টি ক্ষেত্রে নারীর চেয়ে পুরুষ দ্বিগুণ পাবে। পরিশিষ্ট ৮ দেখতে পারেন।
[১৪৮] নারীরা সম্পত্তিতে সমানাধিকার কি আদৌ পাবেন? ডয়চে ভেলে (৭ মে, ২০১৯)
——————–
‘আরও দেখো। নারী বাপের থেকে পাবে, মা থেকে পাবে, স্বামী থেকে পাবে, ছেলে মরে গেলে ছেলের অংশ পাবে। পুরুষও পাবে; কিন্তু নারী স্বামী থেকে মোহরানা পাবে, মাসোহারা পাবে। এটা পুরুষ পাচ্ছে না। এটা নারীর অতিরিক্ত সম্পদ। খরচে বাধ্য না কিন্তু।[১৪৯] আর কত চাই, বলো?’
‘এভাবে অবশ্য ভাবিনি কখনো।’ সব জানা হয়, ভাবাটাই হয়ে ওঠে না।
‘আবার দেখো। পুরুষের আয়ুষ্কাল গড়ে নারীদের চেয়ে কম।[১৫০] ফলে বেশি সম্ভাবনা যে, নারীর জীবদ্দশায় তার পুরুষগুলো মারা যাবে এবং নারীরাই তাদের সম্পত্তি পেয়ে ফেলবে। যদিও খরচে বাধ্য না। আমি তো দেখি সম্পত্তির হিসেবে পুরুষের চেয়ে নারীই লাভে আছে। এরপরও এসব বলে বলে মেয়েদের বিভ্রান্ত করছে, আর আমরা বিভ্রান্ত হচ্ছিও। আফসোস; কেউ নারীবাদ-নাস্তিকতার দিকে পা বাড়াচ্ছি। আর কেউ ভ্রান্ত গুরু-উস্তাজাদের পাল্লায় পড়ে ইসলামি নারীবাদের নামে হাদিস অস্বীকার করছি, পূর্ববর্তী আলিমদের অস্বীকার করছি। সাহাবি-তাবিয়িদের বুঝকে অস্বীকার করে নিজেদের মনমতো ইসলাম বানিয়ে নিচ্ছি।
——————–
[১৪৯] অমুসলিম চিন্তাবিদ Gustave Le Bon তাঁর La civilisation des arabes গ্রন্থে ইসলামি উত্তরাধিকার বিধানকে মূল্যায়ন করেছেন এভাবে— কুরআনে বর্ণিত উত্তরাধিকার নীতি অতীব ন্যায়সঙ্গত ও যৌক্তিক।… এ বিধানকে ফরাসি ও ব্রিটিশ আইনের সাথে তুলনা করে আমার কাছে এ কথা স্পষ্ট হয়েছে যে, ইসলাম স্ত্রীদের উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে এমন সব অধিকার দিয়েছে— যা আমাদের আইনকানুনে খুঁজে পাওয়া যায় না। অথচ আমরা পশ্চিমারা মুসলিম নারীদের তাদের পুরুষদের দ্বারা নির্যাতিত মনে করি।
[১৫০] মেয়েরা গড়ে প্রায় ৬-৮ বছর বেশি বাঁচে পুরুষের চেয়ে। Global Health Observatory : Life expectancy at birth. (Rep.). (2011). WHO website
——————–
আসলেই তো আমরা যুক্তিতে কম, আবেগে বেশি। নইলে এসব আলতু-ফালতু কথা বলে আমাদের ধোঁকা দিয়ে দেওয়া যেত, বলো? এসব মেয়েদের আমরা উস্তাজা হিসেবে নিতাম, যদি একটু চিন্তা-বুদ্ধি করতাম? ইসলামের ব্যাপারে আমাদের ধোঁকা দেওয়া সহজ, বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে দুটো মিষ্টি কথায় আমাদের পটিয়ে ফেলা সহজ। দেখো না, পেপার-পত্রিকায় কী অবস্থা। নিজের কাছেই লজ্জা লাগে, এত সহজ আমাদের বোনেদের ধোঁকা দেওয়া। বখাটে ধোঁকা দেয়, অফিসের বস ধোঁকা দেয়, সেলিব্রিটিরা ধোঁকা দেয়, প্রেমিক দেয়; এমনকি বিবাহিত মেয়েকেও নাকি বিয়ের প্রলোভনে ‘ধর্ষণ’ করেছে দেখলাম। ঝাঁকে ঝাঁকে মেয়েরা ধোঁকা-ই খাচ্ছে কেবল। মানে কী এসবের?’
‘কী একটা বিদিকিচ্ছি অবস্থা। আসলেই তো’।
‘এর সমাধান হলো পরিবার। পরিবারের পুরুষ মানে বাবা, স্বামীকে দিয়ে সিদ্ধান্তগুলো নেওয়ানো। পরিবারই মানুষের রক্ষাব্যূহ। আমরা মুখে যতই বলি, নিজেদের দেহগত প্রক্রিয়াগুলো আমরা নিয়ন্ত্রণ করি না। আমাদের স্বভাবসুলভ দ্বিধা-আবেগ আমরা নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা রাখি না। ব্রেইনম্যাপই এমন, এবং এটাই আমাদের স্পেশালিটি, আমাদের শক্তি। ফলে নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নেওয়া আমাদের জন্য বিপজ্জনক। অপরচুনিটি কস্টগুলোর দ্বিধা একপাশে সরিয়ে জোর করে সিদ্ধান্তগ্রহণ এবং রিস্ক সামলানোর জন্য আমরা টেস্টোস্টেরোনের মুখাপেক্ষী।[১৫১] এজন্য আমাদের ব্যাপারে সিদ্ধান্তগুলো আমাদের বাবা-স্বামীদের হাতে ছেড়ে দেওয়াই আমাদের দেহ-মনের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। নিজে নিজে সিদ্ধান্ত নিতে গিয়েই আমরা ধোঁকাগুলো খাই। আমাদের শক্তিগুলোই সিদ্ধান্তগ্রহণে দুর্বলতা হয়ে দেখা দেয়।’
মাসুদের আনা সম্বন্ধটা ভেঙে গেছে। ছেলে হুজুর তো। বেপর্দা মেয়ে বিয়ে করবে না। ছেলের মা অবশ্য পছন্দ করেছিল ইনফর্মালি দেখে। মাসুদ বোনকে দ্বীনের পথে আনার জন্য চেষ্টা কম করেনি শুরুতে। ভাবী হিসেবে তিথিও কিছু কোশেশ করেছিল। না হলে আর কী করা। তবে এই দফা মিনুকে নামাজ পড়তে দেখেছে তিথি। এভাবেই হয়। জংলা একবারেই সাফ হয়ে যাবে, এ আশা অবাস্তব। তিথি একটু কেটেছে, অমুক শাইখের লেকচার একটু কাটবে, অমুক বান্ধবী একটু কাটবে, তমুক বই পড়ে আরেকটু সাফ হবে। এভাবেই হাঁটি হাঁটি পা পা করে মানুষ চলা শেখে হিদায়াতের রাজপথে। আমাদের কাজ শুধু একটু একটু করে সময় পেলেই হেঁসো নিয়ে এর-ওর জংলা সাফাই করা।
——————–
[১৫১] জার্মানির হামবুর্গ ইউনিভার্সিটির Cognitive Psychology বিভাগের Lisa Marieke Kluen ও Lars Schwabe এবং University Medical Center-এর Psychiatry and Psychotherapy বিভাগের Klaus Wiedemann ও Agorastos Agorastos-এর পরিচালিত গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয় Psychoneuroendocrinology জার্নালে 2017 Oct; vol. 84:181-189। এ ছাড়াও এর আগে Lighthall et al. 2009, Lighthall et al. 2012 ও van den Bos et al. 2009 একই ফলাফল পেয়েছেন। মূলত স্ট্রেস হরমোন কর্টিসল ব্রেনের বিশেষ জায়গাকে উদ্দীপ্ত করে risk-taking behavior সৃষ্টি করে। মেয়েদের ইস্ট্রোজেন হরমোন কর্টিসলকে বাধা দেয় (Moore et al. 1978)। আর পুরুষের টেস্টোস্টেরন বাড়িয়ে দেয় কর্টিসলের কার্যকারিতা (Mehta et al. 2015, Cueva et al. 2015)। এমনকি টেস্টোস্টেরন যে নিজেই বেপরোয়া সিদ্ধান্ত নিতে কাজ করে তার ভুরি ভুরি প্রমাণ রয়েছে (Apicella et al. 2015, Nave et al. 2017) বিস্তারিত দেখুন ডাবল স্ট্যান্ডার্ড ২.০ বইতে।
——————–