আমেরিকা ও তার গণতান্ত্রিকতা


ইউরোপীয় এনলাইটেনমেন্ট প্রজেক্টের প্রথম রাষ্ট্র আমেরিকা (১৭৭৬)। বুঝার জন্য বলছি, ধর্মহীন (সেক্যুলার) ধর্মের ১ম শরীয়া রাষ্ট্র। ফাউন্ডিং ফাদারদের অনেকেই ছিল জন লক-সহ এনলাইটেনমেন্ট দার্শনিকদের ভক্ত, যার আলোকেই রচনা হয়েছিল সংবিধান। ২য় ‘সেকুলার শরীয়া’র রাষ্ট্র ফ্রান্স (১৭৮৯)।

রেনেসাঁর উত্তরাধিকারী এনলাইটেনমেন্ট দর্শনের যে রাষ্ট্রচিন্তা, যার কাঠামো মূলত এথেন্স নগররাষ্ট্রে ‘সিটিজেন’ মর্যাদার লোকদের অংশগ্রহণ। এই কাঠামোর উপর নানান যুক্তিতর্ক যুক্ত করে, চেক-ব্যালেন্স যুক্ত করে গণতন্ত্রের ধারণা দেয়া হয়। এভাবেই ব্যবসায়ী দার্শনিকদের হাতে গণতন্ত্রের জন্ম। রাজা-জমিদারদের নিয়ন্ত্রণ থেকে ব্যবসা বাঁচাতে একটা পরিবর্তনশীল সরকারের ধারণা (দেখুন ড্যানিয়েল ফাসফেল্ডের ‘অর্থনীতিবিদদের যুগ’ বইটি) । আর চার্চের নৈতিকতা আরোপ থেকে ব্যবসাকে বাঁচাতে সেক্যুলার লিবারেল রাষ্ট্রের ধারণা।

ধর্মহীন (সেক্যুলার) এই শরীয়ার হালাল-হারামের ধারণা হল লিবারেল ইথিক্স (অন্যের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করা, সম্মতি ইত্যাদি)। যাকে এখন আরও অপরিহার্য প্রমাণে বলা হয় ‘গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ’। মুসলিম দেশে ইসলামী দলগুলো গণতন্ত্রকে গ্রহণ করলে এই শব্দটা বেশি বেশি আসতে থাকে। তোমরা ইলেকশনে জিতে ক্ষমতায় এসে শরীয়া কায়েম করবা, তা হবে না, তা হবে না। শুধু ভোটে জিতলেই গণতন্ত্র হবে না। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। (জামায়াতের উদ্দেশ্যে ফ.ম.)। শরীয়ার খোয়াব ভুলে যাও। কী কী আছে এই গণতান্ত্রিকতায় (democratism)?

মত প্রকাশের স্বাধীনতা
বাকস্বাধীনতা
সমতা (সবার সমান অধিকার নারী-পুং-টান্স-ঘে)
বহুত্ববাদ
নির্ধর্মীকরণ (সেক্যুলারিজম)
সকলের অংশগ্রহণ
অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচন
সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে সরকার গঠন
স্বাধীন বিচারবিভাগ
মুক্তবাজার
মানবাধিকার (প্রত্যেকের এমনকি খুনী-ধর্ষক, অজাচারী, পশুকামী, ঘে, ট্রান্সকুত্তা, শিশুধর্ষক সবার)

এগুলোই সকল যুগে সকল কালে সকল জায়গায় সার্বজনীন। এগুলোকে কোন প্রশ্ন করা যাবে না। এগুলো না মানলে, সে না-মানুষ, বর্বর, মধ্যযুগীয় এবং হত্যাযোগ্য। এই ফুল প্যাকেজ যদি সাবস্ক্রাইব করে কেউ তার চোখে, এমনকি ইসলামী দলগুলোর চোখেও এসব অস্বীকারকারীরা উগ্রবাদী, মৌলবাদী, জঙি, কয়েদযোগ্য, হত্যাযোগ্য।

স্নায়ুযুদ্ধের সময় যখন আমেরিকা আর সোভিয়েতের মধ্যে মুরগী-ধরার প্রতিযোগিতা। দু’পক্ষই নিজ নিজ প্রডাক্ট দেখিয়ে বিভিন্ন দেশকে দলে টানার প্রবণতা। তখন সোভিয়েত বেচতো: সাম্যবাদ, মজলুমের অধিকার, উচ্চশিক্ষা, এন্টি-সাম্রাজ্যবাদ, এন্টি-উপনিবেশবাদ। আর আমেরিকা বেচতো: জনগণের শাসন (গণতন্ত্র), ব্যক্তিস্বাধীনতা, ব্যক্তিমালিকানা, উদ্যোক্তা, পুঁজিগঠন ইত্যাদি। সোভিয়েতের পতনে পরে একমেরু দুনিয়ায় এই আমেরিকান ইথোস-ই (মূল্যবোধ) সার্বজনীন হয়ে গেল।

ইউক্রেন যুদ্ধ আর ফিলিস্তিন গণহত্যা হল এই যুগের ‘ফুরকান’। সত্যমিথ্যা উন্মোচনকারী। সবার চেহারা এতোটা উন্মোচন হবার পরও যাদের সিদ্ধান্তে বদল আসেনি, তারাই হবে দাজ্জালের সঙ্গী। কাফের লেখাও তাদের কাছে ম্যাটার করবে না।

যে আমেরিকা সারা দুনিয়ায় গণতন্ত্রবাজি করে, সে কত অবলীলায় সংখ্যাগরিষ্ঠ দুনিয়ার মতামতকে হাতের ইশারায় পদদলিত করে। একবার দুইবার না, গত ৮০ বছরে ৪৯ বার ইসরায়েলের পক্ষে সারা দুনিয়াকে কাঁচকলা দেখিয়েছে আমেরিকা। মুখে গণতন্ত্র, অথচ কী নির্লজ্জ স্বৈরাচার। সারা দুনিয়ার সিদ্ধান্ত একপাশে, আর আমেরিকার এই কালোহাত একপাশে। আর এক শ্রেণীর মুসলিম বিশ্বাস করে জাতিসংঘ-মেরিকা সমাধান করবে ফিলিস্তিন সংকটের। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের কথা বলে বলে কী ন্যাক্কারজনক ডাবল স্ট্যান্ডার্ড।

সারা দুনিয়ায় গর্হিত অপরাধীদের মানবাধিকারবাজি করে যে, সে আজ ২০ হাজার শিশু হত্যার পর আরও শিশুহত্যার জন্য হাত তুললো। ফিবছর গাজায় গণহত্যা-শিশুহত্যা চালাতে ৩ বিলিয়ন ডলার দেয় গুন্ডারাষ্ট্রকে। ৫০ হাজার নিরস্ত্র সাধারণ মানুষকে ফুলস্কেল মিলিটারি ইনভেশনে হত্যা করার পর আরও হত্যার জন্য হাত তুললো।

এদের এতো বছরের গণতন্ত্র, মানবাধিকারের বুলি যে ফেইক ছিল, তা যদি মুসলমান না বোঝে, তাহলে সে দোষ আর কাকে দেব। তাদের খুশি রাখতে গণতন্ত্র-মানবাধিকার লিবারেল ডেমোক্রেসির সাফাই গেয়ে যে তাদের মন পাওয়া যাবে না, এটা বুঝতে আপনাদের আর কত দেরি হবে কে জানে। এসব যে ওরাও মানে না, এর চেয়ে স্পষ্ট আর হবে কীভাবে? আপনি ভাবছেন, এসব করলেই বুঝি আমেরিকা আপনাকে স্বীকৃতি দেবে, মসনদে বসিয়ে দেবে। আপনি ইসলাম কায়েম করবেন আর আমেরিকা হাততালি দেবে। এসব তাদের কাছে কোন পবিত্র কালেমা না, তারা এসব মানতে বাধ্য না। স্বার্থের বিরুদ্ধে গেলেই হাত তুলে আপনাকে পিষে ফেলবে।

আল্লাহ এই হাত গুঁড়িয়ে দিক। আমাদের জান-মাল-রক্ত ব্যবহার হোক এই হাত গুঁড়িয়ে দিতে। আমিন। এই হাত মুসলমানের আশীর্বাদের হাত না হোক, মুসলমানের পিঠ চাপড়ে দেবার হাত না হোক।