ইন্টারফেইথ নিয়ে খুব কথা হচ্ছে। কথা হওয়াটা দরকার। ‘আলোচনা না থাকলে বাতিল দাফন হয়ে যায়’ এই কথাটা এই নেটের যুগে ঠিক নয়। বরং আলোচনা না থাকলে একতরফা ব্রেইনওয়াশ হয়।
‘ইন্টারফেইথ ডায়লগ নবিজিও করেছেন’ কথাটা অনেকটা এমন ‘খেলাফত গণতান্ত্রিক সিস্টেম’ বা ‘ইসলামে ধর্মনিরপেক্ষতা রয়েছে’। মানে আক্ষরিক অর্থে ডিকশনারি মিনিং-এ নিয়ে পরিভাষার পিছনের দর্শন সম্পর্কে অজ্ঞতা।
ইন্টারফেইথ-একটা প্রোজেক্ট। এই প্রোজেক্টের স্বতন্ত্র লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, দর্শন রয়েছে। এর মানে স্রেফ দুই ধর্মের দুই মানুষের কথোপকথন নয়, যেমনটা নবিজি করেছেন। জাস্ট দুই ধর্মের লোক কথা বলছে, এটাকে যদি ‘ইন্টারফেইথ’ মনে করেন, তবে খালিদ যখন রুস্তমকে বলছে ‘জিযিয়া দাও’ সেটাও একটা ইন্টারফেইথ ডায়লগ, যেহেতু দুই ধর্মের লোক কথা বলছে। ইন্টারফেইথ মানে আরও বেশি কিছু।
বর্তমান জাতিরাষ্ট্র ব্যবস্থা কৃত্রিম জাতিবোধ তৈরি করে। আমার আগের একটা লেখায় বলেছি। জমিতে দাগ দিয়ে বলে দেয় এটুকু তোমার দেশ, এর ভিতরের সবাই তোমার আপন, এর বাইরের সবাই তোমার পর। পরের দুঃখে তোমার নাক গলানোর কিছু নেই। ওটা আমাদের আভ্যন্তরীণ ব্যাপার। নিজ সীমানার মধ্যে সকল ধর্মের লোকেদের নিয়ে গড়ে তোলা এই কৃত্রিম জাতি গঠন করা হবে যাতে ধর্মীয় জাতিবোধ (উম্মাহ চেতনা) না থাকে। এই কৃত্রিম জাতিটার জোর করে কিছু কমন আবেগের জায়গা তৈরি করা হবে: পতাকা, জাতীয় পশু, পবিত্র গ্রন্থ, রোমান্টিক হিরো, একজন পিতা ইত্যাদি। আবশ্যিকভাবে এই জাতিরাষ্ট্রটা চলবে ধর্মনিরপেক্ষতা নামক সফটওয়্যার দিয়ে। এবং থাকবে রিলিজিয়াস প্লুরালিজম: সকল ধর্মের সহাবস্থান। ইন্টারফেইথ হল এই কৃত্রিম জাতিবোধ টেকসই করার (পড়ুন উম্মাহ চেতনা নির্মূল করার) আরেক প্রোজেক্ট। এখানে আপনার ভিতর এই বার্তা দেয়া হবে:
১.
সকল ধর্ম সমান, ইসলাম আলাদা কিছু না।
২.
ধর্মের ভিত্তিতে পার্থিব কিছু হতে পারে না: জাতি গঠন, রাষ্ট্রগঠন, সমাজ গঠন। সেজন্য সংগ্রাম-যুদ্ধ। আধ্যাত্মিকভাবে সকল ধর্ম একই। ইন্টারফেইথকে ‘আধ্যাত্মিক সেক্যুলারিজম’ বললে স্পষ্ট হয় দর্শনটা।
৩.
শিরক ও কুফর যার যার অধিকার। কাফিরদের মাঝে দাওয়াহ… ব্যাপারটা অনর্থক করে তোলা হয়। নিষ্প্রয়োজন। ইসলাম এখন সবচেয়ে প্রসারণশীল ধর্ম। এটাকে ট্যাকল দিতে এই ইন্টারফেইথ।
৪.
শিরক ও কুফরকে সম্মান করা শেখানো হবে। মানবজাতির জন্য শিরক-কেও একটা অপশন হিসেবে মেনে নেয়া।
৫.
শিরক-কুফরের প্রতি ইসলামের কোনো এলার্জি নেই, এটা শেখানো হবে।
৬.
ইসলামের প্রচারবাদী ও প্রতিষ্ঠাবাদী বৈশিষ্ট্যকে অস্বীকার। ইসলাম জাস্ট আরেকটা ফেইথ… ইন্টারফেইথ।
সরলমনা প্রাচীন আলিমগণ এসব আধুনিক ফিতনা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকবেন না, এটাই স্বাভাবিক। আর এসব রাজনৈতিক বক্তব্য দ্বারা উম্মাহর কোনো ফায়দা হয়নি গত ১০০ বছর। রাজনৈতিকতার চেয়ে স্পষ্ট শব্দে ইসলামের হুকুম ও তার যৌক্তিকতা জানিয়ে দেয়াটাই মুসলিম ও অমুসলিম সকলের অন্তরে চিন্তার ঝড় তোলে। ইসলাম যদি সব ফেইথের মত আরেকটা ফেইথই হয়, তাহলে ইসলাম নিয়ে তাদের নতুন করে ভাবার কী দরকার? নতুন কিছুর প্রতিই তো মানুষ আকর্ষিত হয়। বরং ইসলাম যে আলাদা কিছু, এটা বুঝালেই সে ইসলামের প্রতি আগ্রহ অনুভব করবে। মুসলিমদের উম্মাহ চেতনা, উম্মাহ দরদ, খেলাফতের প্রতি উন্মুখ করার জন্য স্পষ্ট শব্দে শরীয়ার হুকুম জানিয়ে দেয়াটাই রাজনৈতিক। শরীয়া ভূমিতে কাফির কী কী নিরাপত্তা পায়, যা আজ পাচ্ছে না, সেটা তুলে ধরাটাই প্রকৃত আক্ষরিক ইন্টারফেইথ ডায়লগ হওয়া উচিত।
পলিটিক্স অর্থই ‘টু গেইন পাওয়ার’। যেমন ফেমিনিস্ট পলিটিক্স, এলজিবিটি পলিটিক্স। এইসব ‘রাজনৈতিক’ বক্তব্য দিয়ে উম্মত বা নিদেনপক্ষে ভারতের মুসলমানরা কতটুকু পাওয়ার গেইন করেছে আমি জানিনা। তবে স্পষ্ট শব্দে অনমনীয় দাওয়াহ তার চেয়ে বেশিই করতো, কম না। সংখ্যালঘু অবস্থায় এটা আরও বেশি দরকার। মনের জোর বাড়িয়ে রাখাই সবচেয়ে বড় পলিটিক্স। হাকিকাতজু, আসিফ আদনানরা উম্মতের মনের পাওয়ার গেইন করে আরও বড় পলিটিক্স করছেন ইনশাআল্লাহ। আমাদের ইমামদের অনমনীয় অবস্থান আমাদেরকে দীনের উপর আরও শক্ত করে। বিপরীতে তারা ইসলামকে গুরুত্বহীন (আলাদা কিছু না, সকল ধর্ম মানুষকে মুহাব্বতের কথা বলে) জাতীয় কথাবার্তা বললে সংখ্যাগুরুর চাপে সংখ্যালঘু মুসলিম আরও দুর্বল হয়ে পড়ে। ‘রাজনৈতিক’ কথা বলেও পার পাওয়া যায় না।
আমি ইয়াকীনী বিশ্বাস করি। ওমর সুলাইমান ও ইয়াসির কাযীও সমকামিতা হালাল মনে করে না। মনে মনে তারা একে হারামই মনে করে, এলজিবিটি আন্দোলনকে কুফরই মনে করে। কিন্তু রাজনৈতিকতা-র স্বার্থে সংখ্যালঘুত্বের ঘানি কাটাতে বাহ্যিকভাবে পাশে থাকে বা অস্পষ্ট কথা বলে। রাজনৈতিকতার স্বার্থে অস্পষ্ট কথা বলা, কুফর বার্তা প্রদানকারী সমাবেশে যাওয়া, এবং গিয়ে ইসলামের অবস্থান জোর দিয়ে বলতে না পারা থেকে আল্লাহ আমাদের আলিমদের রক্ষা করুন।
আমাদের আগের আলিমরা ছিলেন আপোষহীন। অন্য ধর্মের লোকের সাথে বিতর্ক-মুবাহাসা করতে যেতেন। আর আজ আলিমরা অন্য ধর্মের সাথে একমত হবার জন্য যাই। আহ!