জাতীয়তাবাদ


জাতীয়তাবাদ নিয়ে ক’দিন ফেসবুকে খুব লেখালেখি হল। বিভিন্নপন্থী ইসলামিস্টরা লিখলেন নিজ নিজ পন্থার সাথে যেভাবে ব্যাখ্যা করলে ব্যাপারটা ‘হয়’, সেভাবে। আমি মোটামুটি কয়েকটা পোস্ট শেয়ার করেছি যেগুলো বাস্তবতার কাছাকাছি মনে হয়েছে। মোটাদাগে সবাই যে জায়গায় গিয়ে আটকেছে সেটা হল: নবিজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদিসে বর্ণিত ‘আসাবিয়াত’ দিয়ে আধুনিক কালের জাতীয়তাবাদ ধারণাকে বুঝার চেষ্টা। কেউ বলেছেন আসাবিয়াত আর জাতীয়তাবাদ একই, সুতরাং হারাম। আর কেউ বলতে চেয়েছেন, এক না। আসাবিয়াত হারাম, জাতীয়তাবাদ ভালো জিনিস এবং একটা গ্রহণযোগ্য বাস্তবতা।

এখানে ৩টা আলাদা আলাদা বিষয় আছে।

  • স্বজাতিবোধ/স্বাজাত্যবোধ (খালদুনের আসাবিয়াত)
  • জাত্যাভিমান/উগ্র জাতিপ্রীতি (হাদিসের আসাবিয়াত)
  • জাতীয়তাবাদ/ন্যাশনালিজম

আলাদা বিষয়কে আলাদা ভাবেই বুঝতে হবে। এক ‘আসাবিয়্যাত’ শিরোনামে সবগুলোকে বুঝার চেষ্টা ভুল। জোর করে মিলিয়ে দেয়া যাবে, কিন্তু বাস্তব কিছু হবে না।

১) স্বজাতিবোধ/ স্বাজাত্যবোধ (খালদুনীয় আসাবিয়াত, যা সাম্রাজ্য গঠন করে)। এটা দেশপ্রেম না। দেশ কনসেপ্টটাই আলাদা। দেশ আর জাতি আলাদা কনসেপ্ট। আধুনিক জাতিরাষ্ট্র ঠিক কী জিনিস সেটা হয়ত লাস্টে বুঝা যাবে। জাতিপ্রেম দোষণীয় নয়। ইসলাম একে ধারণ করে। নবিজির মক্কার প্রতি ভালোবাসা ছিল। উমার রা. মাআদ বিন আদনানের কথা বলেছেন। আরব জাতির ফযীলত বিষয়ক কথাবার্তাগুলো এর অন্তর্ভুক্ত। এটা স্বত:স্ফূর্ত বিষয় এবং একে ইসলামের পক্ষে কাজে লাগানো যায়। যেমন ইসলামের জন্য আমার জাতি/গোত্রের অবদানকে আমি আরও তুলে ধরব। বিভিন্ন গোত্রের আলাদা পতাকা ছিল।

নবিজির মক্কাপ্রীতিকে অনেক তথাকথিত আলিমও দেশপ্রেম হিসেবে চালিয়ে দিচ্ছেন। ‘দেশ’ ‘জাতিরাষ্ট্র’ ধারণা সম্পর্কে অজ্ঞতা এর কারণ।

২) জাত্যাভিমান/উগ্র জাতিপ্রীতি (হাদিসের আসাবিয়াত)। অন্যায়েও নিজ জাতির পক্ষ নেয়া, যেটা সরাসরি হাদিসে নিষেধ করে দেয়া হয়েছে। ‘পিতার লিংগ কামড়ে ধরে থাকা’র সাথে নবিজি তুলনা করেছেন। এটা উম্মাহর ভিতর পার্থিব কারণে ফাটল ধরায়। এটাও স্বত:স্ফূর্ত, কিন্তু ন্যায়ের প্রশ্নে নিয়ন্ত্রণ হওয়া উচিত। এবং কঠোরভাবে হাদিসে নিষিদ্ধ। শুধু জাতির ক্ষেত্রেই না, নিজ পেশার সমাজ, নিজ ঘরানা-মাসলাক, নিজ জ্ঞাতিগুষ্টি, নিজের সাবেক ক্যাম্পাস নিয়ে এধরনের মানসিকতাও নিন্দনীয় ও উম্মাহ-চিন্তাকে খণ্ডবিখণ্ডকারী।

৩) জাতীয়তাবাদ। এটা উপরের দুই ধারণার চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা ও নতুন এক ধারণা (গত ২০০ বছরের)। আগের দুই বিষয়ের যেকোনো রেফারেন্স এনে একে ঠিক বা ভুল প্রমাণের চেষ্টা অবান্তর। কেউ বলছেন: নবির যুগে আলাদা পতাকা ছিল গোত্রগুলোর, অতএব আজকের পতাকাপূজাও ঠিক আছে। নবিযুগে উমার রা. কুরাইশপ্রীতির কথা বলেছেন, অতএব আজকের জাতীয়তাবাদেও কোনো সমস্যা নেই। আরবজাতির ফযীলাত এসেছে হাদিসে, সুতরাং নিজ জাতিকে সর্বশ্রেষ্ঠ ভাবায় কোনো সমস্যা নেই। এগুলো হয় নিতান্ত শিশুতোষ তুলনা, নয়তো জাতীয়তাবাদ, দেশ, পতাকা এসবের আধুনিক ধারণা সম্পর্কে না বুঝা কিংবা না বুঝতে চাওয়ার ফল।

জাতীয়তাবাদ আর আসাবিয়াত এক জিনিস না। আসাবিয়াত বড়জোর গুনাহ। জাতীয়তাবাদ নিয়ে আলোচনার শেষে সচেতন পাঠক বুঝতে পারবেন, এটা আসলে কী? এবং এর শরঈ হুকুম কী হওয়া উচিত। আধুনিক জাতীয়তাবাদ ধারণার কয়েকটি খুটি রয়েছে, যার উপর পুরো ধারণাটি নির্মিত।

১.
জাতিরাষ্ট্র সীমানার সার্বভৌমত্ব (ওয়েস্টফেলিয়ান সোভারেন্টি)
আধুনিক জাতীয়তাবাদ একটা চাপিয়ে দেয়া কৃত্রিম আবেগ। কৃত্রিম জাতিসত্তা। প্রথম দুটোর মত স্বত:স্ফূর্ত ভাবাবেগ না। স্যার র‍্যাডক্লিফের টেনে দেয়া দাগের ওপাশে কেউ ‘আপনার’ না। সে হোক আপনার ভাষার (পশ্চিমবংগ, ত্রিপুরা, রোহিংগা), হোক আপনার ধর্মের। তাদের কোনো বিপদে আপদে আপনি এগিয়ে যাওয়ার অধিকার রাখেন না।

আরব জাতীয়তাবাদী পতাকা বৃটিশরা ঠিক করে দিয়েছিল। সেখান থেকে আজকে মধ্যপ্রাচ্যের নানা দেশের পতাকা। একই ভাষা, একই ধর্ম, একই জাতি। কিন্তু বৃটিশ ও বৃটিশের সন্তান মুনাফিকরা আলাদা করে রেখেছে।

ইউরোপের শতবর্ষব্যাপী যুদ্ধ শেষে ওয়েস্টফেলিয়ায় যে চুক্তি হয় লড়াইরত পক্ষগুলোর মাঝে, সেখানে এই ধারণা জন্ম নেয়। এর আগে এক এলাকার ক্যাথলিকদের বিপদে অন্য রাজ্যের ক্যাথলিকরা এক হয়ে উদ্ধারে আসত। এক এলাকায় প্রোটেস্ট্যান্টদের বিপদে প্রোটেস্ট্যান্ট ইউনিয়ন গঠন করে ঝাঁপিয়ে পড়ত। এই চুক্তি দ্বারা রাষ্ট্রসীমানার সার্বভৌমত্ব ও দাগের অন্যপাশের সহমর্মীদের হস্তক্ষেপের উপর আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা (ওটা ওদের আভ্যন্তরীণ ব্যাপার) আরোপ হল।

বর্তমানে সকল আধুনিক রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক আইনের ভিত্তি এই সার্বভৌমত্বের ধারণা। বলেন দেখি এর ফলে ইসলাম ও উম্মাহর কী সমস্যা হল? ইসলামে জি:হাদের বিধান আটকে গেল। আক্রমণাত্মকটা খলিফার উপর ওয়াজিব, আমপাবলিকের জন্য ফরজে কিফায়া। কিন্তু রক্ষণাত্মকটা যে পর্যায়ক্রমে ফরজে আইন ছিল, সেটা আটকে গেল। উম্মতের ফরজ তরক হতে লাগল এই ওয়েস্টফেলিয়ান ধারণার প্রয়োগে। “তোমাদের কী হল যে, তোমরা এগিয়ে আসছো না নির্যাতিত অসহায় মুসলিমদের সাহায্যে?” কুরআনে আল্লাহর এই প্রশ্নের আর কোনো উত্তর উম্মাহর কাছে রইল না।

কথা হল, এই ওয়েস্টফেলিয়ান সোভারেন্টির ধারণা তাহলে কি? এর শরঈ হুকুম কি? উপনিবেশের মওকায় ইউরোপ যে ধারণা চাপিয়ে দিল। র‍্যাডক্লিফ লাইন (পাক-ভারত), ডুরান্ড লাইন (আফগান-পাক), সাইকস-পিকো চুক্তি (সিরিয়া-জর্ডান-ফিলিস্তিনের দাগ), বিসমার্কের দেয়া দাগ (আফ্রিকার দেশগুলো)। এই দাগগুলোর শরঈ হুকুম কী হবে? যা ফরযে আইনকে রুখে দেয়। সন্তানকে নামাযে যেতে দেবেনা বলে যে বাপ বেধে রাখে তার ফতোয়া কী?

ফিলিস্তিনে মজলুম ভাইদের সাহায্যে এজন্য যেতে পারছি না। আমাদের শাসকরা আমাদের আটকে রেখেছে।

সুতরাং জাতীয়তাবাদ এই আইল-বাদের উপর দাঁড়ানো। মালদহের চাপাইভাষী মুসলিম আপনার কেউ না। ত্রিপুরার কুমিল্লাভাষী মুসলিম আপনার কেউ না, আরাকানের টেকনাফভাষী মুসলিম আপনার কেউ না। এই কৃত্রিম মতবাদ অরগানিক জাতিসত্তাকে টুকরো করে আর আইল-এর ভিত্তিতে নতুন জাতিসত্তা গঠন করে। কীভাবে?

২.
রিলিজিয়াস প্লুরালিজম (বহুধর্মীয় জাতীয়তা)
আইলের ভিতরে ভিন্নভাষা ভিন্নধর্ম ভিন্ন কালচারের লোককে ‘নিজের’ বলে গছিয়ে দেয়। তাদেরকে ওউন করতে বলে. অর্গানিক জাতিসত্তা ভেঙে কৃত্রিম জাতিসত্তা তৈরি করে। এর ফলে কী হবে জানেন তো? আর কোনোদিন নতুন সভ্যতা গড়ে উঠবে না। পাশ্চাত্য সভ্যতাকে চ্যালেঞ্জ করার মত নতুন সভ্যতা না গড়ে উঠার এটা একটা কারণ। খালদুনীয় আসাবিয়াত (জাতিশক্তি) তৈরি হবে না, যা নতুন সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে পারত। এটা নিয়ে আরেকদিন বিস্তারিত লিখতে হবে।

জাতীয়তাবাদ প্লুরালিজমের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা বহুধর্মীয় বহু-নৃতত্ত্বের জাতীয়তাকে মেনে নিতে বাধ্য করে। এক সূত্রে গেঁথে দেবার চেষ্টা করে। কমন কিছু না থাকলেও কমন কিছু জিনিস চাপিয়ে দেয়। জাতীয় সংগীত-পশু-পাখি-মসজিদ-মাছ-ফুল-উৎসব। একটা ধর্মনিরপেক্ষ ধর্ম তৈরি করে, যার আলাদা উৎসব-পার্বণ আছে। ধর্মসংগীত আছে, যেটা সবাই মিলে গাইতে হয়, না গাইলে মহাপাপ। রক্তে লেখা পবিত্র কিতাব আছে। আছে পবিত্র পৌরাণিক বীরত্বের কাহিনী, যাকে বিনাপ্রশ্নে বিশ্বাস করতে হয়। আছে মূর্তি যাদের সম্মান জানাতে হয়, ফুল-মোম দিয়ে উপাসনা করতে হয় (শিখা, পতাকা)। আছে নবিদের মত মহাপুরুষ ও শ্রেষ্ঠ মানুষেরা।

এই নতুন ধর্মের বিধান কী?
কুরআনের এসব আয়াত কি রহিত হয়ে গেছে?
‘কাফিররা এক জাতি (মুসলিমদের মোকাবেলায়)’… ‘কাফিররা কখনোই তোমার উপর সন্তুষ্ট হবে না, যতক্ষণ না তুমি তাদের দীন অনুসরণ করছো’… ‘তোমরা কাফিরদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু (ওয়ালি) হিসেবে গ্রহণ করো না’… তাওহিদের অন্যতম বিষয় ‘ওয়ালা-বারাআ’ (বন্ধুত্ব ও সম্পর্কচ্ছেদ) এবং হুব্ব-বুগদ লিল্লাহ (আল্লাহর জন্য কাউকে ভালোবাসা এবং আল্লাহর জন্য শত্রুতা রাখা) এসব হুকুম এসে আটকে যায় আধুনিক জাতীয়তাবাদের কাঠামোয়। শুধু আটকেই যায় না, উলটে যায়। রাষ্ট্রসীমার কারণে মুসলিমের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ আর কাফিরের সাথে ওয়ালা করিয়ে দেয় আধুনিক জাতীয়তাবাদ। মনে করুন সেই পোস্টারটার কথা ‘বাঙলার হিন্দু, বাঙলার মুসলমান…. আমরা সবাই বাঙালি’।

জোর করে জাতি নির্মাণ

৩. ধর্মনিরপেক্ষতা:
ফলে অটোমেটিক ধর্মনিরপেক্ষতা ছাড়া আপনার আর কোনো অপশন থাকে না। কিংবা সেক্যুলারায়নের কাছে ধর্ম হিসেবে জাতীয়তাবাদ ছাড়া আর কিছু থাকে না। সুতরাং এরা পরস্পরের পরিপূরক। একে অপরকে কমপ্লিট করে। অতএব প্রতিটি ইঞ্চি ইঞ্চি থেকে ধর্মকে বিদায় করে দেয়া হয়। নৈতিকতা-আধ্যাত্মিকতা কিছুর জন্যই আর ধর্মের প্রয়োজন নেই। ধর্ম হয়ে যায় ফোর্থ সাবজেক্ট, তার বদলে আসে ‘ভালো থাকা’ সাবজেক্ট।

রাষ্ট্রব্যবস্থা, বিচার-আইন, অর্থব্যবস্থা ইত্যাদি থেকে ইসলামকে বের করে দেয়ার হুকুম কী?

জাতীয়তাবাদকে ‘আসাবিয়াত’ দিয়ে পাঠ না করে এর ইতিহাস-দর্শন দিয়ে পাঠ করা প্রয়োজন।

আরও আছে. আপাতত এটুকু ভাবলাম. আপনারাও ভাবুন এই এংগেলে। এগুলো মুফতি সাহেবরা বলে দেবে এরপর জানব, এমন বিষয় না। এগুলো স্বত:স্ফূর্তভাবে বুঝার বিষয়।