নাইন্টিজে আমাদের বলা হয়েছিল, বন্ধু ছাড়া লাইফ ইম্পসিবল। বন্ধু-আড্ডা-গান। হারিয়ে যাও। ডিজ্যুস সারারাত বন্ধুদের কথা বলার সুযোগ করে দিলো। এখানে বন্ধু মানে ছেলে-ছেলে মেয়ে-মেয়ে বন্ধুত্বের কথা বলেনি তারা। তারা দেখিয়েছে ছেলে-মেয়ে বন্ধুত্ব। সেসময় ছেলে-মেয়ে প্রোপোজ করতো না। বন্ধু হতে চাইতো। এসো বন্ধু হই।
প্রেম ব্যাপারটা একটা ভাববাদী দর্শনের মতো ছিল। সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় লিখেছিল: You can do 3 things with a woman. You can love her. You can suffer for her. You can turn her into a literature. কী সুন্দর কথা। কোথাও কাম নেই, শরীর নেই। নিষ্কাম প্লেটোনিক প্রেম। নীল খাম চিঠি, ছ্যাঁকা খাওয়া সাহিত্য-গান, স্বর্গ-থেকে আসা প্রেম। একটা ধর্মীয় ভাইব ছিল। প্রেমধর্ম।
পরিবারগুলো কঠোর ছিল এ ব্যাপারে। যার কারণে মেয়েরা এক্সেস দিতো না। ছ্যাঁকা খাওয়ার রেট বেশি ছিল। অনেকদিন ঘুরাঘুরি করে সীমিত আকারে পজিটিভ সাড়া আসতো বলে মনে হতো। হাই এফোর্ট লো রেজাল্ট। প্রেম করা ব্যাপারটা লাভজনক ছিল না।
ধরা পড়লে কপালে দুঃখ ছিল। আর ধরা পড়ার চান্সও ছিল খুব হাই। বলে দেয়ার লোকের অভাব ছিল না। সবাই ব্যাপারটাকে খারাপ ভাবতো। ভাবি, আপনার মেয়েকে তো দেখলাম… আপনার ছেলেকে দেখলাম অমুকের মেয়েকে নিয়ে… মায়েদের হাতে খুন্তি ছিল। বাপেদের হাতে জুতা ছিল। ভূত তাড়ানো হতো। মেয়েদের হাত ধরা, কোমড় ধরে ঘোরাঘুরি করা, রিকশা-বাসর করা, রুমডেট করা, বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে প্রভৃতি করার কথা কল্পনায়ও আনা যেত না। সমাজ পরিচ্ছন্ন ছিল। নুডুলসের প্যাকেট, মৃত ভ্রূণ এতো এভেইলেবল ছিল না। পেপার পত্রিকায় এসব নিউজের সয়লাব ছিল না।
শিক্ষাব্যবস্থা, নাটকপাড়া, সংবাদমাধ্যম, ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া সবাই মিলে ২০ বছরে আমাদেরকে কেমন বানিয়ে ফেলেছে, দেখুন। বাবা মায়েরা কেমন যেন হয়ে গেছে। ছেলের পছন্দ আছে, মেয়ের নিজের পছন্দ আছে। এটা নর্মাল। বয়ফ্রেন্ড-গার্লফ্রেন্ডকে নিজের বাসায় আনা যাচ্ছে। বাপমায়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া যাচ্ছে। বাপ-মা বাসায় না থাকলেও আনা যাচ্ছে। সবাই সব মেনে নিয়েছে। এলাকার লোকও আর বাপমায়ের কানে দেয় না। কানে দিলেও বাপমা বলে: ক্যাম্পাসের ভিতরেই যা পারো করো, বাইরে এসে আমাদের প্রেস্টিজ খেও না। বন্ধুদের সাথে শত শত মাইল দূরে মেয়ে চলে যাচ্ছে। ছেলে যাচ্ছে মেয়েবন্ধুদের সাথে ঘুরতে৷ যেন কিচ্ছু হয়নি, কিচ্ছু হবে না। কিচ্ছু হতে পারে না।
একই টিভির সামনে বসে আমাদের সময়ে শুক্রবারের বই দেখা হতো। সেখানে দুটো ফুল দিয়ে মাখামাখি বুঝানো হতো। তাও আমরা চোখ নামিয়ে নিতাম। একটু মাখামাখির এড এলে উঠে চলে যেতাম। এখন একসাথে ইংরেজি, হিন্দি সিনেমা দেখা হচ্ছে। নেটফ্লিক্স দেখা হচ্ছে। নাটকে পর্নোশব্দ, সমাকামিতা, রুমডেট, মদপান দেখছে বাপমা-ছেলে-মেয়ে মিলে। এখন ব্যাপারটা আর রাখঢাকে নেই। এখন সবাই সব জানে। বাস্তবে হলেও মেনে নেবে, মেনে নিচ্ছে।
ফ্যাসিবাদ হটানো আপনা জায়গায় জরুরি। জুলুম বন্ধ করা অবশ্যই জরুরি। কিন্তু এই সামাজিক অবক্ষয় ‘X’কে সরিয়ে ‘Y’ নিয়ে আসলে দূর হবে না। X, Y, Z যে-ই আসুক, এই অবক্ষয় চলবে। এমনকি ফ্যাসিবাদী X-কে সরিয়ে যে Y আসবে, সেও দ্বিগুণ অবক্ষয়ের কমিটমেন্ট করেই তাকে আসতে হবে। নারীবাদ, সমকাম, ইসলামবিদ্বেষের চলমান প্রক্রিয়াকে সুরক্ষা দেবার কমিটমেন্ট X-এর চেয়ে বেশি না দিলে Y-কে তো আসতেই দেয়া হবে না। অনেকেই আশা করে বসে আছে, ফ্যাসিবাদ নিপাত গেলেই ইসলাম প্রতিষ্ঠা হয়ে যাবে সমাজে। কী সরল আমরা। এতো সরলকে বোকা বলা হয়। আর কতবার আশাভঙ্গ হলে আপনাদের সম্বিৎ ফিরবে?
তাহলে করণীয় কী? রাষ্ট্র লেভেলে এফোর্ট কমিয়ে সমাজ লেভেলে এফোর্ট বেশি দেয়া। যতদিন নিজের ভেলা নিজে ভাসাতে না পারি। অন্য কারও ভেলায় চড়ে ইসলামের ঘাটে পৌঁছার চিন্তা করিয়েন না। তার ভেলায় চড়লে আমাকে তার ঘাটেই নামতে হবে। এই সহজ হিসাব না বুঝার ভান ধরে থাকলে আমাদের কপালে আরও দুঃখ আছে। একবার মুসলিম লীগের ভেলা, একবার বিএনপির ভেলা। এভাবে না। রাজনৈতিক কাজগুলো প্রেসারগ্রুপ হিসেবে কাজ করার ভিতরই সীমাবদ্ধ রাখা।
আপাতত আমাদের দরকার একটা পরিপূর্ণ দাওয়াতের কাজ। পরিপূর্ণ। রাজনৈতিক হাকিমিয়্যার সাথে তাসাউফী আবেগ। আর তাবলীগী দাওয়াতী মেজাজের সাথে শক্ত বুদ্ধিবৃত্তিক যুক্তিচিন্তা। সাইয়্যিদ কুতুব প্লাস যুলফিকার নকশবন্দী প্লাস ইলিয়াস কান্ধলভী প্লাস হাকিকাতজু। আপাতত কল্পনায় এমনই আসতেছে।