মডার্নিটি সময়কালটা ঠিক কবে থেকে শুরু তা নিয়ে অনেক মত আছে। সাল হিসেব না করে বরং কী কী জিনিসকে মডার্নিটি বলা হয়, সেটা ধরে এগোলে বুঝা সহজ। তাই মডার্নিটিকে মডার্নিজম বলতে পছন্দ করেন অনেকে।
এই যে কথায় কথায় আপনারা শুনতে পান: ‘একুশ শতকে এসে পুরোন চিন্তা নিয়ে পড়ে আছো’, ‘আধুনিক হও’, ‘আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান’। কখনও ভেবেছেন কী এই আধুনিক/আধুনিকতা? এর মানে কি জাস্ট ‘নতুন’, ‘সাম্প্রতিক’, ‘নয়া’? নাকি এর পিছনে আছে অন্য কোনো চিন্তা-দর্শন-দৃষ্টিভঙ্গি?
মডার্নিজম একটা বিশেষ ইউরোপীয় চিন্তাকাঠামো। খৃষ্টবাদের সাথে টানাপোড়েনে ইউরোপ যে অভিজ্ঞতা লাভ করেছে সেই অভিজ্ঞতার আলোকে মুক্তি-উন্নতির একটা চিন্তা জন্ম নিয়েছে। রেনেসাঁ হয়ে এনলাইটেনমেন্ট হয়ে শিল্পবিপ্লব হয়ে গত ৮০০ বছর ধরে এই চিন্তাকাঠামোটা জন্ম নিয়েছে। এই দৃষ্টিভঙ্গিটাকেই নাম দেয়া হয়েছে ‘সভ্যতা’ এবং উপনিবেশী শাসনের মওকায় অ-ইউরোপীয় জনগোষ্ঠীর উপরে এই ‘সভ্যতা’টাকে চাপানো হয়েছে।
অথচ প্রয়োজন মনে করা হয়নি ‘নেটিভরা এই ব্যবস্থা চায় কি না’, ‘নেটিভদের অভিজ্ঞতাটা ভিন্ন কি না’। উইলিয়াম হান্টার, কর্নেল থমাস মুনরো, উইলিয়াম বোল্টস সহ একাধিক রাজপুরুষ উল্লেখ করেছেন: ভারতীয়দের সভ্যতা-মূল্যবোধ-শিক্ষাদীক্ষা ইউরোপের চেয়ে উন্নত না হলেও কোনো অংশে কমও নয়। অথচ এই নেটিভদের সভ্যতাকে ‘দানবীয়’রূপে ইউরোপে তুলে ধরবার জন্য নিরলস খেটেছে ওরিয়েন্টালিস্টরা। ইউরোপে এবং ইউরোপমনা নেটিভদের কাছে এসব সভ্যতাকে অসভ্য, বর্বর, ইতর, নারীবিদ্বেষী হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। তৈরি করা হয়েছে এসব অসভ্যদের সভ্য করার জাস্টিফিকেশন।
এভাবেই অর্গানিক সমাজ-কাঠামো ও মূল্যবোধগুলোকে দানব হিসেবে উপস্থাপন করা হয়৷ আধুনিক দুনিয়ায় দানবত্ব হল: তালব্য-ন, কিউ, জ.ঙ্গি। কাউকে দানব বানাতে এগুলো দাগা হয়। যারা মডার্নিটির বিরুদ্ধে কথা বলতে চায়, এই চাপিয়ে দেয়া সভ্যতাকে প্রশ্ন করতে চায়, আত্মপরিচয় খুঁজতে চায়, তাদেরকে দানব প্রমাণ করা হয়। এবং সরিয়ে দেয়া, পুরে ফেলার জাস্টিফিকেশন হয়ে যায়।
গতকালের প্রেসব্রিফিং-এর পর (জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়) এই সহজ জিনিসটা না বুঝার কিছু নাই। ভিসি আদর্শিকভাবেও তাদেরই লোক, সমান ইসলামবিদ্বেষী। কিন্তু সরিয়ে দেবার জাস্টিফিকেশনের জন্য, দানব বানানোর জন্য ব্যবহার করা হল সেই শব্দগুলোই (তালেবানী শাসন, মৌলবাদ)।
পূর্ববঙ্গীয় বাঙালি মুসলিম মূল্যবোধ নিয়ে কথা বলায় হিন্দু ধর্মাবলম্বী অনেকে টিটকারি দিয়েছে। অথচ ছেলেমেয়েরা সন্ধ্যার পর বাইরে থাকবে না, হায়া, পর্দা এগুলো ট্রেডিশনাল হিন্দু সমাজেরও মূল্যবোধ। বাবামায়ের মুখে আজও গ্রামের কোনো বিশেষ সম্ভ্রান্ত হিন্দু নারীর গল্প শুনতে পাবেন যার চেহারা কেউ কোনোদিন দেখেনি। আমি শুনেছি। আজও গ্রামের হিন্দু মেয়েরা এতো লম্বা করে টেনে ঘোমটা দেয় যে চেহারা দেখা যায় না।
মডার্নিটি শুধু ইসলামের বিরুদ্ধেই নয়, বরং প্রতিটি ট্রেডিশনাল সমাজের মূল্যবোধের বিরুদ্ধে। বিংশ শতকের শুরুতে গুরুত্বপূর্ণ প্যাপাল বুল আছে মডার্নিজমের সাথে চার্চের মোকাবেলা কীভাবে হওয়া দরকার সেসব নিয়ে। খৃষ্ট সমাজকেও মডার্নিটি শেষ করে দিয়েছে, যেভাবে দিয়েছে হিন্দু সমাজকে। হিন্দুরাও যদি আসল শত্রুকে না চেনে (মডার্নিজম), তাহলে হিন্দুসমাজও ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে ইউরোপের মতো। হিন্দুদের ঘরে ঘরেও সমকামী, স্বামী-সন্তানকে শত্রু ভাবা নারীবাদী রাক্ষসী, এর-ওর সাথে লিভ টুগেদার করে বেড়ানো কুলটা জন্ম নেবে। হিন্দু সমাজ এজন্য তৈরি তো?
যদি পরিবার-সমাজ বাঁচাতে চান, মুসলিমদের মতো রুখে দাঁড়ান মডার্নিজমের নামে আধুনিকতার নামে ওপেন কালচারের নামে এইসব সাম্রাজ্যবাদী দালালদের।
ছবি: বইয়ের নাম ‘অবাধ্যতার ইতিহাস’ | সমকালীন প্রকাশনী