ওকে, লেটস টক এবাউট দিস। ভোগবাদের এই যুগে আমরা অত্যন্ত ক্ষুদ্র গণ্ডির ভিতর চিন্তা করি। অনলাইনে সোশ্যাল মিডিয়ার ফলে এটা আরও শর্ট হয়ে গেছে। চিন্তার সময় বা কষ্ট কোনোটাই করার টাইম নেই। একটা ঘটনাকে শুধু আগের দুইদিন পরের দুইদিন দিয়ে বুঝা যায় না। ভারতের বা উপমহাদেশের যেকোনো সিঙ্গেল ঘটনা শুধু ঘটনার জন্যই ঘটেনা। এর রয়েছে সুদীর্ঘ ঘটনা পরম্পরা। কানহাইয়া হত্যা কি শুধুই ২০২২ সালে উগ্র দুইজন মুসলিমের ক্ষণিকের ধর্মান্ধতা? নাকি এর পেছনে আছে দীর্ঘ কোনো ইতিহাস? ধর্মের বাইরেও কোনো সামাজিক-রাজনৈতিক অস্তিত্বের হিসেব-নিকেশ?
আমি আপনাদের নিয়ে যাচ্ছি, হিন্দুদের চোখে সবচেয়ে জঘন্য ও অত্যাচারী মুসলিম শাসক আওরঙ্গজেবের যুগে। মুসলিমদের প্রতি হিন্দুদের ঘৃণার উৎস বুঝাতে বার বার বাদশাহ আলমগিরের শাসনামলের রেফারেন্স টানা হয়। বাদশাহ আলমগীর হলেন হিন্দুদের নিজেদের মজলুম দাবির মোটামুটি কেন্দ্র বলা যায়। হিন্দু নির্যাতন, হিন্দু নিগ্রহের সকল উপাখ্যান আওরঙ্গজেবকে কেন্দ্র করে ঘোরে। খুব সংক্ষেপে আমরা দেখে নেব ‘সবচেয়ে প্রতিকূল’ শাসকের আমলে হিন্দুরা কতখানি নিগৃহীত ছিল।
চাকরি ক্ষেত্রে নিগ্রহঃ
- ‘হিন্দুদের কাছে জনপ্রিয়’ বাদশাহ আকবরের আমলে ১৪ জন হিন্দুকে ‘মনসবদার’ উচ্চপদে নিয়োগ দেন। আর আওরঙ্গজেব ওই পদে ১৪৮ জন হিন্দুকে নিয়োগ দিয়েও ভিলেন। [শ্রীশর্মা, মোগল গবর্নমেন্ট, পৃ:১১১]
- গভর্নর পদেও হিন্দুদের নিয়োগ দেয়া হত। যশোবন্ত সিংকে মুসলিম এলাকা কাবুলের গভর্নর বানিয়েছিলেন আওরঙ্গজেব। এমনকি শত্রু শিবাজীর আপন জামাই অচলাজী ৫ হাজারী মনসবের সেনাপতি ছিল, আরেক আত্মীয় আজূজী ছিল ২ হাজারী। এছাড়া তাঁর সেনাপতিদের মাঝে ছিল রাজা রাজরূপ, অর্ঘ্যনাথ সিং, দিলীপ রায়, কবীর সিং, প্রেমদেব সিং। রাজস্ব বিভাগের প্রধান ছিলেন রসিকলাল ক্রোরী। [গোলাম মোর্তজা, চেপে রাখা ইতিহাস]
- ভূমি ব্যবস্থাপনা (কানুনগো বিভাগ) ছিল একচেটিয়া হিন্দুদের হাতে। সামগ্রিকভাবে হিন্দু-মুসলমানে ক্ষমতার একটা ভারসাম্য ছিল। [সুবোধকুমার মুখোপাধ্যায়, বাংলার আর্থিক ইতিহাস, ১৯৮৫]
এই সময় রাজস্ব আদায়, হিসাবপত্র রাখা, রাজদরবারে পত্রনবিশের কাজ প্রায় হিন্দুদের একচেটিয়া ছিল। হিন্দু চৌধুরি, হিসাবনবিশ ও পত্রনবীশরা সকলেই ফার্সি ভাষায় রীতিমত দুরস্ত ছিল।
[বিনয় ঘোষ, বাদশাহী আমল, পৃ: ৩৮]
- আওরঙ্গজেবের ফরাসি চিকিৎসক ফ্রাঁসোয়া বার্নিয়ের জানাচ্ছেন:
১৫-১৬ জন রাজার ধনৈশ্বর্য ও সামরিক শক্তি খুব বেশি। বিশেষ করে চিতোরের রাণার, রাজা জয়সিংহের ও রাজা যশোবন্ত সিংহের। এই ৩ জন হিন্দু রাজা যদি একবার হাত মিলিয়ে একত্রে কোনো অভিযান করার সংকল্প করেন, তাহলে মোগল সম্রাটের সিংহাসন তারা টলিয়ে দিতে পারেন। এই রকম আরও শতশত রাজ রাজড়া ও জমিদার আছে যারা সম্রাটকে কোনো কর দেন না এবং প্রায় স্বাধীনভাবে নিজ রাজ্যে প্রভুত্ব করেন।
[বাদশাহী আমল, বিনয় ঘোষ, পৃ: ৭৪]
আওরঙ্গজেব যদি হিন্দুদের উপর এতো অত্যাচারই করতেন, যা বলা হয়; তবে আওরঙ্গজেবের চেয়ে শক্তিশালী হিন্দু রাজারা তার পক্ষে সেনা পরিচালনা করেছেন দিনের পর দিন। এটা ঐতিহাসিকভাবে হাস্যকর।
ধর্মীয় ক্ষেত্রে নিগ্রহঃ
- হিন্দুধর্মের জঘন্যতম প্রথা ‘সতীদাহ’-তেও মোগল বাদশাহরা হাত দেয়নি। ধর্মের অন্যান্য বিষয়ে বাধা দেয়া তো দূর কি বাত। আকবর আইন করে এতটুকু বন্ধ করেন: ‘কেবল স্বেচ্ছায় সতীদাহ হতে চাইলে, পারবে। জোর করে কাউকে সতীদাহ করা যাবে না’। ১৬৬৩ সালে বাদশাহ আওরঙ্গজেব রহ. এর সময় এই আইনকে আরও নিয়মকানুন ও শর্তের বেড়াজালে আরেকটু ‘অসম্ভবপ্রায়’ করে ফেলা হয়। ব্যস, এতোটুকুই।
- বলা হয়ে থাকে, আওরঙ্গজেব প্রচুর হিন্দু মন্দির ভেঙ্গেছিলেন। বিভেদের রাজনীতি শুরুর আগে পাঠ্যবইতেই ছিল:
“জোর করিয়া মন্দির ভাঙিয়া মসজিদ নির্মাণের উদ্দেশ্যই যদি আওরঙ্গজেবের থাকিত, তবে ভারতে কোনো হিন্দু মন্দিরের অস্তিত্বই বোধহয় আজ দেখা যাইত না। সেইরূপ করা তো দূরের কথা, বরং বেনারস-কাশ্মীর ও অন্যান্য স্থানের বহু হিন্দুমন্দির ও ততসংলগ্ন দেবোত্তর ও ব্রাহ্মোত্তর সম্পত্তি আওরঙ্গজেব নিজের হাতে দান করিয়া গিয়াছেন; সে সকল সনদ আজ পর্যন্ত বিদ্যমান”। যেমন চিত্রকূটের বালাজী মন্দিরের দলিল।
[শ্রীঘোষ, ইতিহাস পরিচয়, ৫ম-৬ষ্ঠ শ্রেণী, হিন্দুস্থান প্রেস ১০, রমেশ দত্ত স্ট্রীট, কলিকাতা]
এই বইয়ের ১৩৮ পৃষ্ঠায় ছিল:
আওরঙ্গজেবের দীর্ঘ ৫০ বছরের রাজত্বের মধ্যে এমন কোনো প্রমাণ কেহ দেখাইতে পারে নাই যে, তিনি কোথাও কোনো হিন্দুকে জোর করিয়া মুসলমান করিয়াছেন। বা তাহার ধর্মে হস্তক্ষেপ করিয়াছেন।
মোগল বাদশাহ মুসলমান হলেও হিন্দুদের এইসব ধর্মকর্মে, আহার-অনুষ্ঠানে হস্তক্ষেপ করতেন না কখনও।…
[আওরঙ্গজেবের ফরাসি চিকিৎসক ফ্রাঁসোয়া বার্নিয়ের, বাদশাহী আমল, বিনয় ঘোষ, পৃ: ১৬৪]
- হিন্দুদের উপর আওরঙ্গজেব জিযিয়া আরোপ করেন বলে সে খারাপ। প্রফেসর যদুনাথ সরকার রচিত Mughal Administration গ্রন্থে আছে: আওরঙ্গজেব ৬৫ প্রকার কর উঠিয়ে দেন, এজন্য রাষ্ট্রের সেই বাজারে বছরে ৫ কোটি টাকার উপরে ক্ষতি হত। তাঁর আমলের প্রথম ১৬ বছর ধরে ৬৫ প্রকার মতান্তরে ৮০ প্রকার ট্যাক্স উঠিয়ে হিন্দুদের উপর শুধু জিযিয়া নামক কর আরোপ করেন। A Vindication of Aurangzeb গ্রন্থে ঐতিহাসিক সাদিক আলি দেখিয়েছেন: ৮০ টি কর বিলোপ করে আওরঙ্গজেব প্রশংসা পাননি, একটি কর আরোপের জন্য এতো কোলাহল।
এই হচ্ছে মুসলিমদের প্রতি হিন্দুদের ঐতিহাসিক ঘৃণার বাস্তবতা। ঘৃণার কেন্দ্রেরই এই অবস্থা, তাহলে পেরিফেরির বাস্তবতা কেমন হতে পারে, তা অনুমেয়। কীভাবে ‘মুসলিম শাসনে হিন্দু নিগ্রহের এই কাল্পনিক চিত্র’ আপামর হিন্দুদের মনমগজে গেঁথে দেয়া হল তা আমরা সামনে দেখবো।
১৮২৯ সালে প্রকাশিত হল লেঃ কর্নেল জেমস টড (১৭৮২-১৮৩৫) রচিত Annals & Antiquities Of Rajasthan বইটি। সেখানে দেখানো হল: ইংরেজ আসার আগে হিন্দুদের উপর কী অবর্ণনীয় অত্যাচার চালানো হয়েছে। রাজপুত ও বাঙালি জাতিকে ইংরেজ উদ্ধার না করলে তো এরা নিঃশেষই হয়ে যেত। ইত্যাদি ইত্যাদি। কী ছিল এতে? বলছেন ড. প্রভাতকুমার, বিভাগীয় প্রধান (বঙ্গভাষা ও সাহিত্য), বিজয়গড় জ্যোতিষ রায় কলেজ, কলকাতা:
যে চারণগীতিকে ঐতিহাসিক যদুনাথ সরকার ‘আফিমখোরের গালগল্প’ বলে অবহেলা করেছেন, টডের তাই-ই ছিল উপজীব্য। … যদিও টড যে যুগে মেবার রাজ্যের বীরত্বের কাহিনী লিখেছেন, সে যুগে মেবার ছিল মারাঠা আক্রমণে বিপর্যস্ত (নট মোগল), কুশাসনে দুর্বল ও আফিমের আসক্তিতে মেরুদণ্ডহীন। … রীতিমত সাম্রাজ্যবাদী বুদ্ধির দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েই টড ইচ্ছাকৃতভাবেই এটা করেছেন। শুধ টড নন, বৃটিশ ঐতিহাসিকরা সবাই এটাই দেখাবার চেষ্টা করেছেন যে, মোগলের পরাধীন রাজপুত ও বাঙালি জাতি, দুই জাতিকেই চরম অত্যাচারের হাত থেকে রক্ষা করেছে বৃটিশ শক্তি।
[দেশাত্মবোধ ও ঐতিহাসিক বাংলা নাটক, সাহিত্যপ্রকাশ, কলিকাতা ১৩৮৫]
এই গ্রন্থের ভূমিকায় একদিকে আটশ’ বছরের মুসলিম শাসনের বিরুদ্ধে তীব্র বিষোদ্গার করা হয়েছে দলিল ছাড়া। এবং অন্যদিকে অতীত মহত্ত্বের কথা ও হিন্দু ধর্মীয় দর্শনের শ্রেষ্ঠত্ব বয়ান করেছেন টড সাহেব। ইংরেজি ভাষায় এর ৩টি সংস্করণ বের হলেও ভারতীয় (বিশেষ করে বাংলা) ভাষায় এর অসংখ্য অননুমোদিত সংস্করণ প্রকাশিত হয়। ঊনবিংশ শতকে ভারতে ও বাংলায় এটাই ছিল সর্বাধিক প্রচারিত পুস্তক। (অনুবাদক: বরদাকান্ত মিত্র, অঘোরনাথ বরাট ও উপেন্দ্রনাথ মুখার্জী)। জেমস টড জীবনে বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌহদ্দি পেরোননি। লেখক, ইতিহাসবিদ হিসেবে কোনো পরিচয় পাওয়া যায়নি। সামরিক কর্মচারীর সাথে সাথে তিনি রাজস্থানে কূটনীতিবিদের দায়িত্বে ছিলেন। ভারতে ইংরেজের Divide & Rule নীতির সাথে মিলিয়ে নিন। মুসলিম কর্তৃক হিন্দু অত্যাচারের কাল্পনিক ‘আফিমখোরের গালগল্প’-কে তিনি ইতিহাসের মর্যাদা দিয়ে এ দেশে সাম্প্রদায়িকতার বীজ বুনে দিলেন। আর তা গ্রহণ করে নিল ‘বঙ্গীয় পৌত্তলিক রেনেসাঁ’র রচয়িতাগণ।
এরপরই বাংলা ভাষায় অগণিত নাটক-উপন্যাস রচনার হিড়িক পড়ে যায় রাজপুত বীরত্বের কাহিনী নিয়ে। তৎকালীন কলকাতা-কেন্দ্রিক বাঙালি উচ্চবর্ণ হিন্দু নাট্যকার, ঔপন্যাসিক, কবি, সঙ্গীত রচয়িতা ও সাহিত্যিকদের মধ্যে আনন্দের হিল্লোল বয়ে যায়। বিশেষ করে ১৮৮০-১৯০৫ পর্যন্ত লিখিত নাটকগুলো। আর সেসময় গণমাধ্যম ছিল এইসব নাট্যশালা আর পত্রপত্রিকা। গবেষক ড. গোস্বামী লেখেন:
‘হিন্দু রিভাইভালিজম’ মানে এভাবেই ইংরেজের দাসত্বের সাথে মুসলিমবিদ্বেষ। কাল্পনিক গালগল্প দিয়ে ঐতিহাসিক নাটকের নামে (তুলনা করুন আজকাল বলিউডের ঐতিহাসিক সিনেমাগুলোতে কীভাবে ইতিহাস বিকৃত করা হয়েছে) মুসলিম বিদ্বেষের ভিত্তিতে হিন্দু জাতীয়তাবাদ গঠন করা হলো। পরবর্তী ইভেন্টগুলো হচ্ছে:
- ১৮৬১- রাজনারায়ণ বসু কর্তৃক ‘জাতীয় গৌরব সম্পাদনী সভা’। অনুষ্ঠানপত্রে তিনি ‘হিন্দু ব্যায়াম’, ‘হিন্দু সঙ্গীত’, ‘হিন্দু মেডিসিন’, ‘হিন্দু শাস্ত্র’ অবলম্বনে সমাজ সংস্কারের ডাক দেন।
- ১৮৬৭- জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়িতে ‘হিন্দু মেলা’ প্রতিষ্ঠা
- ১৮৭২- বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকা চালু
- ১৮৭৬- বাঙালি বর্ণহিন্দুদের দাবিদাওয়া আদায়ে ‘ভারতসভা’ বা ‘ইন্ডিয়ান এসোসিয়েশন’ প্রতিষ্ঠা
হিন্দুদের কাছে খলনায়ক আওরঙ্গজেব-বিরোধিতা থেকে হিরো হয়ে ওঠে মারাঠা দস্যু ছত্রপতি শিবাজী। খেয়াল করার বিষয় দেশ পরাধীন কিন্তু ইংরেজদের কাছে। আর ভিলেন এখন মুসলিমরা। ভিলেন এখন বাদশাহ আলমগীর যার আমলে হিন্দুরা অধিকার পেয়েছে সম্রাট আকবরের চেয়েও বেশি। দিনের পর দিন মারাঠাদের হাতে লুণ্ঠিত (বর্গীর হামলা) বাঙালি হিন্দু জমিদারেরাও শিবাজিকে হিরো মেনে নেয়। ১৮৯৩ সালে মারাঠা হিন্দু শিল্পপতিরা আর ১৯০২ সাল থেকে কোলকাতার হিন্দুরা শিবাজী উৎসব শুরু করে। ড. প্রভাবকুমার গোস্বামী লেখেন:
কারা ছিল এই মারাঠারা? কে ছিল এই শিবাজী, যাকে কেন্দ্র করে হিন্দু জাতীয়তাবাদের উত্থান? কী ছিল তাদের সাথে আওরঙ্গজেবের আচরণ?
হিন্দুত্ববাদ এক কাল্পনিক ইতিহাসের উপর দাঁড়িয়ে। এক কাল্পনিক বীরত্বগাঁথার উপর দাঁড়িয়ে। এক কাল্পনিক দোষারোপের বলি হয়ে চলেছে ভারতীয় মুসলিমরা। মিথ্যা, অসত্য, ঘৃণা, বিদ্বেষ আর কল্পনা একত্রিত হলে যা হয় তার নাম হিন্দুত্ববাদ। কোনো সচেতন হিন্দু যদি খোলামন নিয়ে ইতিহাস পাঠ করে তার সামনে সত্য স্পষ্ট হবে আশা করি।
সহায়ক পাঠ:
- কোলকাতা কেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবী, এম. আর. আখতার মুকুল
- বাদশাহী আমল, বিনয় ঘোষ
- চেপে রাখা ইতিহাস, গোলাম আহমদ মোর্তজা