তুর্কি খিলাফতে এবং মোগল সালতানাতেও ‘শাইখুল ইসলাম’ একটা গুরুত্বপূর্ণ পদ ছিল। যাঁরা সুলতানের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েও হস্তক্ষেপ করতে পারতেন। সমাজে আলিমদের প্রভাব ছিল। কাযী হিসেবে, শিক্ষক হিসেবে, আমলা হিসেবে। কারণ শিক্ষাব্যবস্থা ছিল একমুখী, ফলে স্পেশালিস্ট না হলেও ন্যূনতম ইলমী গণ্ডি শিক্ষিত মুসলিম মাত্রই পেরোতেই হতো। অফিসিয়াল ভাষা ছিল ফার্সি। আইন ছিল শরীয়া আইন। আইন ম্যানিপুলেশন হতো না, এ দাবি করাটা যৌক্তিক হবে না। তবে ওভারঅল শরীয়া আইনের সুবিধাগুলো সমাজের মানুষ পেতো। অপরাধপ্রবণতাও বেশি ছিল না সমাজব্যবস্থা ও মোবিলিটি কম হবার দরুন। নৈতিকতা ছিল উচ্চ, এখনকার মতো ছিল না মানুষ।
বাদশাহ জাহাঙ্গীরের সময় ভারতে এসেছিলেন স্যার থমাস রো (1581 – 1644)। তিনি বলে গেছেন:
‘সকলের ভিতর আতিথেয়তা ও দানের ঝোঁক, তার চেয়েও বড় কথা দুর্বলকে রক্ষা করা ও তাদের জানমালের নিরাপত্তার প্রতি খেয়াল রাখা— এসব এমন বৈশিষ্ট্য যা দেখে এ জাতিকে অশিক্ষিত বর্বর বলা যায় না। তাদের যেসকল গুণের কথা বললাম, তাতে ভারতীয়দেরকে ইউরোপীয় জাতিসমূহের তুলনায় কোনোভাবেই নীচ বলা যায় না’।
The Embassy of Sir Thomas Roe to India 1615-1619
বৃটিশ এলো। চাকরি হারালো মুসলিমরা। সেনাবাহিনীগুলো ভেঙে গেল। ১৮৩৫ অব্দি ফিরিঙ্গি জজও বসতো, সাথে কাযীও বসতো। নতুন দন্ডবিধি এলে বিচারব্যবস্থা থেকেও ইসলাম পুরোপুরি উঠে গেল। রাজভাষা ফার্সি বদলে ইংরেজি করে দেয়াতে মুসলিমরা আলিমরা চাকরি হারালো। বৃটিশের অব্যাহত লুটপাটে ১৮০১ থেকে ১৯০০ পর্যন্ত ১০০ বছরে ৩১ টা মন্বন্তরে মরলো ৪ কোটি ১০ লাখ মানুষ—‘না খেয়ে’। অভাবে স্বভাব নষ্ট হয়। আমাদেরও নৈতিকতা বদলে গেল। অতিথিপরায়ণ, দানশীল, দুর্বলের রক্ষক একটা জাতি হয়ে গেল স্বার্থপর, চোর, দুর্নীতিবাজ। যেমন রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠী অব্যাহত জুলুমের দরুন টিকে থাকার প্রয়োজনে জাতিগতভাবেই উচ্ছৃঙ্খল হয়ে গেছে (দীনী ভাইদেরই রিপোর্ট এমন)। আমরাও হয়ে গেলাম পুঁজিবাদী, টাকার গোলাম, সম্পদলোভী।
১৮৫৭-এর আযাদী পর্যন্ত ওয়াহাবী আন্দোলন শিরোনামে যত আন্দোলন-বিদ্রোহ আমরা পাই, সবগুলোই আলিম-সুফিদের নেতৃত্বে। তারা বার বার ইসলামকে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন। ১৮৫৭ সালে চূড়ান্ত দমন-পীড়ন-হত্যাযজ্ঞের শিকার হয়ে যুদ্ধের নীতি ত্যাগ করে দাওয়াতের নীতি গ্রহণ করেন। দেওবন্দ আন্দোলন। বৃটিশের সেই শাসন-দমনের চিত্র আমরা আজও চলতে দেখি। আসলে বৃটিশ থেকে স্বাধীন আমরা আজও হইনি, পোস্টমডার্নিটি এদেশে এখনও শুরু হয় নি। লর্ড মেকলের সন্তানরাই এনলাইটেনমেন্ট-মডার্নিটি দর্শন দিয়ে দেশ চালাচ্ছে। এনলাইটেনমেন্ট দর্শনের কাছে ক্ষমতা হারিয়েছে ইসলাম।
দেখেন গত ২৫০ বছর ইসলাম নেই এস্টাবলিশমেন্টে। এটা বোনদের বুঝতে হবে। ইসলাম ও ইসলামী কর্তৃপক্ষ নেই ক্ষমতায়। বরং লাগাতার জেল-জুলুম-আন্দামান-গুমের শিকার হয়ে রাম-বাম কর্তৃক মার্জিনালাইজড হয়ে মাসে ৩-৪ হাজার টাকা বেতনের চাকরি করে কোনোভাবে দীনকে টিকিয়ে রেখেছে। ধর্ম নিয়ে যদি ব্যবসা করেই থাকে, তাহলে বলতে হয় ধর্ম নিয়ে ব্যবসা একটা বাজে ব্যবসা। লাভজনক না। আবেগ নিয়ে ব্যবসা লাভের হতে পারে (ভণ্ডপীররা যা করে)। কিন্তু ইলমের ব্যবসাটা ব্যবসা হিসেবে জঘন্য, কোনো লাভ নেই, মর্যাদা নেই। সুতরাং তারা ক্ষমতা রাখে না আপনাকে আপনার ইসলামী অধিকার ফিরিয়ে দেয়ার। মজলুমকেই জালেম সাব্যস্ত করবেন না। আল্লাহ সইবেন না।
বোনকে ভাই মীরাস দিচ্ছে না, স্ত্রীকে স্বামী মাহর দিচ্ছে না। তারা বড়জোর মিন মিন করে মোটিভেশন দিতে পারে। এবং তারা তা দিচ্ছেনও। ওয়াজে, বইপত্রে যতটুকু পারছেন, দিচ্ছেন। কিন্তু না দিলে তাদের কিছুই করার নেই। সেক্যুলার বিচারব্যবস্থা অত্যন্ত ব্যয়বহুল, দীর্ঘসূত্রী বলে বোনেরা ভাইদের নামে মামলাও করতে পারছেন না। বোনদের শিক্ষার ব্যবস্থাও তারা করার ক্ষমতা রাখেন না, আবার সহশিক্ষা জায়েযও বলতে পারেন না। কয়েকটা মাত্র যার সমাধান এখনও করা যায়। তবে লার্জ স্কেলে সেটাও করা যায় না। যেমন ভাই বোনকে সম্পত্তি না দিলে কী করণীয়, সেটা আমাদের হাতে নেই। সেক্যুলার বিচার ব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রিতা, খরচ ও বিচারহীনতার কারণে বঞ্চিত নারী মামলা করার সাহসও পায় না। যেটা ইসলামী বিচার ব্যবস্থা থাকলে হতো না। শুধু মোটিভেশনে চিড়ে ভেজে না। আইনের উপর ইসলামের নিয়ন্ত্রণ না থাকা একটা বিরাট কারণ।
মসজিদে মেয়েদের আসার ব্যবস্থা করতে বলার অধিকার তারা রাখেন না। মসজিদে তারা কর্মচারী। সাহাবীদের যুগেই মসজিদে আসতে গিয়ে নারী ধর্ষিতা হয়েছে, এই যুগে তাইলে কী হবার কথা। এসব মাথায় রেখে গণহারে আসতে বলার পরিবেশ এখন নেই। ধরেন ফতোয়া দিয়ে দিলাম নারীরা মসজিদে আসবে। এরপর সেই দূরে আহ্লাদীপুর গ্রামে সালাতে আসতে গিয়ে কোন নারী ধর্ষিতা হবে না, এই গ্যারান্টি তারা দিতে পারেন না। এমনিতেই যা হচ্ছে, এরপর আরেকটা সুযোগ করে দেয়াটা হয়তো তার চাচ্ছেন না। কোনো কোনো নারীর কর্মজীবী হবার প্রয়োজন পড়ে। এটা তারা জেনেও নারীর জন্য আলাদা কর্মক্ষেত্রে করে দেবার ক্ষমতাও রাখেন না, আবার দীনী দায়িত্বের কারণে জায়েযও বলে দিতে পারেন না। ব্যক্তিগতভাবে আপনি পরামর্শ করলে কাউকে কাউকে অনুমতি দিতে পারেন পর্দার সাথে করার। কিন্তু ঢালাওভাবে বলাটা কি প্রাগমেটিক, আপনিই ভাবেন?
ইসলামকে সিস্টেম হিসেবে চায়, এমন মানুষ মুসলিম বিশ্বে সংখ্যালঘু। আপনাদের এই আলেমবিদ্বেষ মূলত সংখ্যালঘুবিদ্বেষ ও মজলুমবিদ্বেষ। মজলুমবিদ্বেষ মানে জালেমের পক্ষাবলম্বন। এইসব ফেমিনিস্ট আপুদের আর সিম্পদের কোনোদিন দেখেছেন সেক্যুলারিজম নিয়ে, পশ্চিমা দর্শন নিয়ে কিছু লিখেছে? কিছু বলেছে? তারা ইসলামী অধিকার চায়, কিন্তু ইসলামকে যারা দমন করে রেখেছে, তাদের বিরুদ্ধে এরা কোনোদিন কিছু বলেছে? না। বরং শাহবাগী, শাহবাগপ্রেমী, নাস্তিকদের সাথে এরা হাসাহাসি করে মুসলিমদেরকে নিয়ে, উপহাস করে মজলুম সংখ্যালঘুদের নিয়ে যারা গত ২৫০ বছর কোনোক্রমে টিকে আছে।
হ্যা, আমাদের ভুল আছে। আমরা যেটুকু করার ছিল সেটুকু করিনি। তারপরও কি আপনাদের এই ট্রল, এই বিদ্বেষ, এই নির্মম দোষারোপ ভ্যালিড। পশ্চিমা লিবারেলিজম ও ফেমিনিজমের তালে তাল দিয়ে যে জেন্ডার-স্ট্রেস আপনারা তৈরি করছেন, তা কি ইসলামের পক্ষে যাচ্ছে? বরং হওয়া তো উচিত ছিল ‘মুমিন পুরুষ ও নারী পরস্পরের সহযোগী’। একসাথে তারা ইসলামের বিজয়ে কাজ করবে। আপনাদের কাছে অনুরোধ: মজলুমবিদ্বেষ ছাড়ুন। মজলুমের পক্ষে বলুন। বোনেরা নারীবাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। আর ভাইয়েরা বোনেদের বিপক্ষে না দাঁড়িয়ে পক্ষে দাঁড়ান। সেক্যুলার কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে বোনদের ইসলামসম্মত অধিকার আদায় করে দিন (মসজিদ কমিটিও সেক্যুলার কর্তৃপক্ষ)। ভাইবোনেরা মিলে পশ্চিমা মতবাদের উপরে ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব তুলে ধরুন।
‘এইড ফর ম্যান’ জাতীয় গ্রুপ যা করছে, তা আল্টিমেটলি নারীবাদের পক্ষেই কাজ করছে, তৈরি করছে জেন্ডার-স্ট্রেস, ঠিক যেটা নারীবাদ চায়। গ্রুপের এডমিনরা আমার মেসেজটা নিবেন প্লিজ। এগুলা কইরেন না। প্রশ্ন করতে পারেন, একচেটিয়া আলেমদের বেনিফিট অফ ডাউট দিয়ে গেলাম কেন? মুসলিমকে আলিমদেরকে বেনিফিট অফ ডাউট না দিয়ে যদি আমার সব বেনিফিট অফ ডাউট শাহবাগী, ফেমিনিস্টরা পায়; ধরে নেবেন আমার ঈমানে অসুখ ধরেছে। আল্লাহ আমাকে ‘আলেমদের সিম্প’ হিসেবে হাশরে উঠাক।