উচ্চবর্ণহিন্দু: পর্ব ১


হিন্দুত্ববাদ খুব স্পষ্টভাবে উচ্চবর্ণহিন্দুর কনস্ট্রাক্ট। বাঙালি বর্ণহিন্দুর হাতে এর শুরু হলেও, ঠিকাদারি চলে যায় গুজরাট-মহারাষ্ট্রের শিল্পপতি ও ব্রাহ্মণদের হাতে। আজকের ভারতে বাঙালি হিন্দুদেরকেও হেয় মনে করা হয়। আর নিম্নবর্ণজাত হিন্দুদের কথা বলাই বাহুল্য। সুতরাং ‘শিবাজীয় হিন্দুত্ববাদ’ আসলে বাঙালি হিন্দুদের জন্যও উত্তম অপশন কি না, সেটা হিন্দুদের পড়তে হবে, জানতে হবে, ভাবতে হবে। বিশেষ করে পূর্ববঙ্গের নিম্নবর্ণরা পূর্ববঙ্গের মুসলিমের মতোই উচ্চবর্ণের কাছে মজলুম। রামরাজ্য তাদের জন্য গলার কাঁটা হয়ে যাবে কি না, হিন্দুধর্মের আকীদাগত বর্ণপ্রথা ফেরত আসবে কি না, এসব ওনাদের মাথায় নিতে হবে। হিন্দু-মুসলিম উভয়ের জন্য উপমহাদেশে হিন্দুত্ববাদের ইতিহাস পড়া অত্যন্ত জরুরি। কর্মপন্থা ঠিক করতে হলে, জানতে হবে এর উত্থান কীভাবে হল।

আমি যে সেই শুরু থেকে খেটে-খাওয়া আম-হিন্দুর প্রতি সহমর্মিতার সুরে কথা বলছি, সে কারণটা বুঝতে পারবেন। নিচের প্রতিটি পয়েন্টের সাথে জড়িয়ে আছে ‘উচ্চবর্ণের হিন্দু’ (সুবর্ণ হিন্দু এলিট শ্রেণী)। সব ডটগুলো কানেক্ট করবেন।

<image1>

১. বৃটিশ ভারতের ১৫৩ বছরের রাজধানী কোলকাতা।

২. বাংলার সাথে বেঈমানি (জগৎশেঠ, উমিচাঁদ, রায়দূর্লভ, নবকৃষ্ণ)

৩. ইংরেজদের বিশ্বস্ত রাজস্ব কর্মচারী, এজেন্সি হাউসগুলোয় ব্যবসায়িক পার্টনার হিসেবে প্রচুর অর্থের মালিক।

৪. এই অর্থ যেন এরা শিল্পে খাটিয়ে ইংরেজদের প্রতিপক্ষ না হতে পারে, এজন্য চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত। জমিদারিতে ইনভেস্ট করে এসব নব্যধনী বাঙালি হিন্দু এলিটরা জমিদার হল।

৫. হিন্দু কলেজ স্থাপন করাল বৃটিশদের দিয়ে। শিক্ষাদীক্ষায় এগিয়ে গেল। তৈরি হল: পয়সাওয়ালা হিন্দু এলিট ও শিক্ষিত হিন্দু মধ্যবিত্ত। দুটোই কেবলমাত্র উচ্চবর্ণের বাঙালি হিন্দু। বহু পরে কায়স্থরা শিক্ষাদীক্ষার অনুমতি পায়।

৬. ১৮৩৫ এ ২৫০০ উচ্চবর্ণের বাঙালি হিন্দু ফার্সির বদলে ইংরেজিকে রাজভাষা করার দরখাস্ত দেয়।

৭. ১৮৫৭ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে এই শিক্ষিত বর্ণহিন্দুরা ইংরেজের পক্ষে অবস্থান নেয় ও লেখালেখি করে। যেহেতু এদের শ্রেণিস্বার্থ ইংরেজের সাথে জড়িত।

৮. বেঙ্গল রেনেসাঁর নামে ইংরেজ কৃষ্টি-কালচার, পাশ্চাত্যদর্শন পুরো আত্মস্থ করে। ইংরেজতোষণ অব্যাহত রাখে।

৯. কেবল বঙ্গভঙ্গ হলে এই বর্ণহিন্দুদের সাথে ইংরেজের ক্ল্যাশ বাধে প্রথম। কেন মুসলিমদের সুবিধা দেয়া হল। এরপর তারা স্বাধীনতা কথা ভাবে। এর আগ পর্যন্ত সকল কৃষকবিদ্রোহ, সেনা বিদ্রোহ, সাঁওতাল বিদ্রোহে এরা বৃটিশের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। উপরের এই সকল অবস্থান শিক্ষিত বাঙালি বর্ণহিন্দুদের (উচ্চবর্ণের) একচেটিয়া অবস্থান।

১০. ৩ গ্রুপ হয় এদের মাঝে: পুরোপুরি ইংরেজ ওয়াশ (ইয়ং বেঙ্গল), ইংরেজ ধাঁচে সংস্কারপন্থী (রামমোহন প্রমুখ), হিন্দু জাতীয়তাবাদী (বঙ্কিম, রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দ, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ) বাকিদুটো বিলুপ্ত হয়ে যায়।

মূল মিডিয়া ছিল নাটক, পত্রিকা আর সভাসমিতি। হিন্দু জাতীয়তাবোধ নিয়ে অগণিত নাটক লেখা হয় ও থিয়েটারে থিয়েটারে মঞ্চস্থ হতে থাকে , ভিলেন মুসলিমরা। ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত সহ অন্যদের পত্রিকায় যবন, ম্লেচ্ছ ইত্যাদি বলে মুসলিমবিদ্বেষ ছড়ায়। সবকিছুর মূল ছিল জেমস টড রচিত Annals and Antics of Rajsthan বইটা, যার মূল বক্তব্য হল: বৃটিশরা এসে হিন্দুদের বাঁচিয়েছে মুসলিমদের কবল থেকে। ব্যাঙের ছাতার মত অগণিত সভাসমিতি (তত্ত্ববোধিনী সভা, বেঙ্গল সোশ্যাল সায়েন্স এসেসিয়েশন, ল্যান্ড ওনার্স এসোসিয়েশন, হিন্দুমেলা, ধর্মসভা এমন শতশত) গড়ে ওঠে। এসবে হিন্দু রিভাইবালিজম ও রোমান্টিক জাতীয়তাবাদ চর্চা হতে থাকে।

১১. এদেরই হাত ধরে (সাথে বোম্বেভিত্তিক হিন্দু বণিকসমাজ) মিলে কংগ্রেস দাঁড় করায়, যার উদ্দেশ্য হিসেবে উমাপ্রকাশ ব্যানার্জী বলেছিলেন: বৃটিশদের সাথে সম্পর্ক জোরদার করা।

হিন্দুত্ববাদের জন্ম ‘বাঙালি’ ‘উচ্চবর্ণ’ হিন্দু এলিটদের হাতে। আর অবহেলিত:

  • নিম্নবর্ণের হিন্দু
  • বাঙালি মুসলিম
  • দলিত, হরিজন
  • অন্যান্য প্রদেশ (আসাম, বিহার, উড়িষ্যা, ছোটনাগপুর) এর হিন্দু

আমাদের মনে রাখতে হবে, এই এলাকায় ইসলামপ্রচার ও প্রসার ইসলামের টেক্সট অনুযায়ী হয়নি (দাওয়াত>জিযিয়া>জি.হাদ)। এখানে আগে সুফিরা ঢুকেছেন অবহেলিত নিম্নবর্ণের আশার বারতা নিয়ে। এরপর অত্যাচার চলেছে তাদের উপর। এরপর এসেছেন বখতিয়ার খিলজী ও (শাহজালালের সময় একজন সেনাপতি আসেন)। আমি জানিনা এখনকার পীর-মাশায়েখগণ নিম্নবর্গের হিন্দুদের উপর আর্থিক, আখলাকী মেহনত চালু রেখেছেন কি না। ভারতে কালীম সিদ্দিকী সাহেব সেই ধারাবাহিকতা ধরে রেখেছেন। ৪ লক্ষ হিন্দু মুসলিম হয়েছে ওনার মেহনতে।

<image2>

এ কারণেই আমি ঢালাও সবাইকে হিন্দুত্ববাদের ট্যাগ না দিয়ে নিম্নবর্গের হিন্দুদের উপর মেহনতের পক্ষে। তাদের নিরাপত্তা, আর্থিক, বিপদআপদে সাথে থাকা এগুলোর পক্ষে আমি।

প্রাসঙ্গিক পাঠ:

  • কোলকাতাকেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবী (এম. আর আখতার মুকুল)
  • ভুলে যাওয়া ইতিহাস (ব্যারিস্টার এস. এ. সিদ্দিকী)
  • চেপে রাখা ইতিহাস (গোলাম মুর্তজা)
  • বঙ্গভঙ্গ থেকে বাংলাদেশ (আবদুল মান্নান)
  • বাঙলা ভাগ হল (জয়া চ্যাটার্জী)
  • ইতিহাসের ছিন্নপত্র (কায়কাউস)

Leave a Reply