ভূরাজনৈতিক কারণে আমরা দুই দফা সাম্রাজ্যবাদের শিকার। বৃটিশ আর ভারতীয়। পাকিস্তান যেটা করেছে, দেশভাগের ছিরি দেখেই বুঝে গেছে, এটা হারাতে হবে। এর চেয়ে যতদিন পারি থালা চেটে খাই। মূল খাবার তো বৃটিশ খেয়ে গেছে, চেটে আর যতটুকু পাওয়া যায়। ভারতীয় সাম্রাজ্যবাদ ব্যাপারটা অনেকটা আফ্রিকায় সাবেক ফরাসি কলোনিগুলোর মত। আমি ঋণ দিব, সুদও দিবা, আসলও ফেরত দিবা। সেই আসল দিয়ে জিনিসও আমার থেকে নিবা, সেখানেও লাভ করব। আবার লোকও আমার এখান থেকে নিবা, তাদের বেতনও আসল থেকে দিবা। সে যাকগে, ওটা নিয়ে আমি চিন্তিত না।
চিন্তার বিষয় হল ভারতের মনস্তাত্বিক উপনিবেশ। বৃটিশরা ওরিয়েন্টালিজমের চোখে আমাদের দেখেছে: তারা সভ্য, আমরা অসভ্য। তারা আমাদেরকে কনভিন্স করতে পেরেছিল যে, আমরা শাসিত হবারই যোগ্য। । এটা আমরা মনে প্রাণে মেনেই নিয়েছিলাম, এবং নিয়েছি। কিন্তু ভারত আমাদের কি দিয়ে মানালো? ভারত আমাদের মানালো ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’ দিয়ে। কেমন? বাঙালি জাতীয়তাবাদকে পরম, প্রশ্নাতীত, ধ্রুব সত্য মেনে নেন প্রথমে। এরপর দেখেন ‘সভ্য বাঙালি’ ‘উন্নত বাঙালি’ কারা? বাঙালি সংস্কৃতি বানিয়েছে কারা, লালন করেছে কারা, ভাষা কাদেরটা বেস্ট, বাঙালিয়ানার মুরুব্বিরা কোথাকার? পশ্চিমবঙ্গের। ‘বাঙালি’ ‘বাংলা’ বললেই যা যা প্রথমে ভেসে ওঠে কলকাতা, শান্তিনিকেতন, রবীন্দ্র, নজরুল, শরত থেকে নিয়ে , সবই ওপারের। ‘Better বাঙালি’ হতে হলে মনোরাজ্যে শাসিত হও, শাসন করবে ভারতীয় বাঙলাবাজেরা। ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’ সংবিধানে নিয়েও বাঙালরা বাঙালি হয়ে উঠতে পারেনি। ছবিটা পড়ুন।
<image1>
পশ্চিম যেমন পূর্বকে ছোট করে দেখে বা দেখত। কলকাতার হিন্দু এলিটরাও পূর্ববঙ্গ-কে সে নজরে দেখত, যার প্রমাণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাকালে রবিবাবু সহ তাদের রিয়াকশনে পাওয়া যায়। শরতের লেখায় পাবেন ‘বাঙালি’ (হিন্দু) আর মুসলমানদের মধ্যে ফুটবল খেলার গল্প। আমরা ওদের চোখে ছোটো জাতের বাঙালি, যাকে বলে ‘বাঙাল’। বাঙাল থেকে বাঙালি হয়ে উঠতে পশ্চিমবঙ্গ-চর্চা ছাড়া গত্যন্তর নেই। আমাদেরকে প্রচুর ধ্রুপদী নাচ, নজরুলের শ্যামা সংগীত, রবীন্দ্রচর্চা করতে হবে। প্রকৃত বাঙালি নিজের বাঙালি হবার পথে যা যা বাধা, সবকিছু ঘৃণা করবে। মুসলমানের ‘মুসলমানিত্ব’ না ঝেড়ে প্রকৃত বাঙালি হওয়া যাবে না। আরবি শব্দগুলোকে আনন্দবাজারিকরণ করতে হবে… ঈদকে লিখতে হবে ইদ। শিক্ষা কারিকুলামে প্রচুর পশ্চিমবঙ্গ পড়াতে হবে। ঘরে ঘরে জি-বাংলা দেখে ‘ষোলোআনা বাঙালিয়ানা’ শিখতে হবে।
বাঙালি ও হিন্দু সমার্থক। ‘বাঙালি’ কোনো ভাষাভিত্তিক জাতীয়তা না। আপনি বাঙলাভাষী মুসলিম। কোনোদিনই আপনি বাঙালি মুসলিম হতে পারবেন না। যেমন ধরেন তসলিমা আপী শিবলিঙ্গে পানি ঢেলে বাঙালি হইসে। আপনাকেও ধুনা মুখের উপর ঘুরিয়ে, তিলক কেটে, ঘণ্টা বাজিয়ে, মণ্ডপে গিয়ে, শিবলিঙ্গে দুধ ঢাললে, এরপর গিয়ে বাঙালির সনদ জুটবে। বাঙালি হলে ঐ পর্যায়ে আপনি আর মুসলিম থাকেন না। লিটারেলি।
<image2>
মুসলিম কোনো জাতিসত্তা না, এথনিসিটি না। মুসলিম একটা আধ্যাত্মিক জাতীয়তা। ‘বাঙালি’ কোনো ‘হইতে পারা’র জিনিস না। কাউকে বাঙালি, আমেরিকান, হন্ডুরাসিয়ান ‘হইতে’ হয় না। এথনিসিটি, ভাষাভাষিতা, ভৌগোলিকতা-এগুলা ডেভলপ করার জিনিস না, এগুলা ভাগ্য। যা আছে, তা-ই। ডেভলপ করার জিনিস হলঃ আদর্শ, দৃষ্টিভঙ্গি, দেখার তরিকা। এই জায়গায় এসে বাঙালি হয়েও কেউ পশ্চিমা আর কেউ মুসলিম। কেউ অস্বীকারকারী, কেউ সমর্পিত। আর কেউ আরবি নামের হিন্দু। দুঃখজনকভাবে বঙ্গ এলাকায় মার্কসবাদ, নারীবাদ, সেকুলারবাদ, উদারবাদ ভয়ানকভাবে কলকাতা প্রভাবিত। পশ্চিমাকেন্দ্রিকতার একটা লেভেল আছে। কিন্তু এই কলকেতা-কেন্দ্রিকতার কোনো লেভেল নাই। অত্যন্ত নিম্নমানের চাটাবাজি।
এখানে চমৎকার একটা সমাধান হয়েছে কিন্তু। বাঙলাভাষী মুসলমানের আত্মপরিচয়ের সমাধান। সমাধানটা হল: বাঙলাভাষাী ও বাঙালি দুটো আলাদা টার্ম। বাঙলায় কথা বললেই সে বাঙালি না। সেটা শরৎবাবুর লেখায়, বঙ্কিমের লেখায় রবিবাবুর লেখায়ও ফুটে উঠেছে। শরৎবাবু যেমন দেখিয়েছেন বাঙালি vs মুসলমান ছেলেদের ফুটবল খেলা। মানে কলকাতাকেন্দ্রিক বাঙালি সংস্কৃতি মুসলমানকে বাঙালি হিসেবে জায়গা দেয় না। এরপরও জাত মেরে বাঙালি হবার উদগ্র বাসনা আমাদের মেটেনা। অভাগা বাঙালি মুসলমান। দু’দফা গোলাম। গোলামের বাচ্চা গোলাম। কিন্তু নিজেকে মনে করে শিক্ষিত আধুনিক উদারমনা সেক্যুলার লিবারেল। আসলে গোলামের নাতি গোলাম।