পোশাকের দর্শন: আত্মপরিচয়ের সুঁইসুতো


কোনো সন্দেহ ছাড়া শার্টপ্যান্ট জায়েয এবং পোশাক তাকওয়ার মাপকাঠি না। এরপরও কথা রয়ে যায়। পোশাক যে শুধু পরার জন্য পরার জিনিস না। পোশাকের দর্শন আছে। পোশাকের একটা সিম্বলিজম আছে। পোশাক কিছু কথা বলতে চায়। এটা যেদিন থেকে বুঝছি, সেদিন থেকে শার্টপ্যান্ট আর পরিনি। বরং বেশি কইরা ধরছি জুব্বা-পাগড়ি।

মানুষ ভাবে আমি পোশাক নিয়ে কথা বলতেসি। পোশাক নিয়ে বলার এত কী আছে? অথচ আমি কাপড় নিয়ে কথা বলতেসি না। পোশাক শুধু কাপড়টাকে বলে না। পোশাক আরেকটু বেশি কিছু। নিছক রুচি-পছন্দ বা ‘নাজায়েয তো না’ বলার দ্বারা অনেক কিছুই শেষ হয়ে যায় না। পোশাক একটা জীবনদর্শনের চিহ্ন।

আপনি দেখবেন, ওরা আমাদের পোশাকের উপরই আক্রোশ দেখায়। হিজাব, নিকাব, বোরকা, দাড়ি, টুপি, পাঞ্জাবী। এগুলোকে ওরা ‘ইসলামের চিহ্ন’ হিসেবেই নিষিদ্ধ করে। অথচ আমরা এগুলোকে ‘মুসলিমের চিহ্ন’ হিসেবে মানতে চাই না। যা মুসলিমের ইসলামের ‘প্রকাশ’ সেগুলো এরা দেখতে পারে না। পলিটিক্স অব ড্রেসকোড বা সিম্বলিজম। বইমেলায় দাড়িটুপির আধিক্য দেখলে, স্কুলকলেজে বোরকা-হিজাবের আধিক্য দেখলে সেক্যু-রাম-বাম হতাশ হয়, প্রেসার ফিল করে। এক পর্যায়ে ভুল সিদ্ধান্ত নেয় স্টল বন্ধ করার মতো। যা আরও ভুলের দিকে ওদের ঠেলে দেয়। সুতরাং আইডেন্টিটি পলিটিক্সে পোশাকের ভূমিকা বিরাট… বিরাট। শার্টপ্যান্ট যাদের পোশাক সেই ইউরোপীয় লিওপোল্ড উইস (মোহাম্মদ আসাদ) যা বুঝলেন, বংশপরম্পরায় মুসলিম হয়ে আমরা তা বুঝি কি? উনি নিজেও সারাজীবন ইউরোপীয় পোশাকই পরেছেন। কিন্তু পোশাকের দর্শন নিয়ে যা বললেন, সেটা গুরুত্বপূর্ণ।

কথাটা অনেকেই বলেছেন। ইমাম আবূ হানিফাও বলেছেন। সাহাবী ইবনে আব্বাস রা. থেকেও বর্ণিত। আহলুস সুন্নাহর চিন্তাগত ও কর্মগত বৈশিষ্ট্যগুলো এক কথায় উঠে এসেছে কওলটিতে:

  • দুই শায়খকে শ্রেষ্ঠ মনে করা (আবু বাকর ও উমার রা.)
  • দুই জামাতাকে মুহাব্বাত করা (উসমান ও আলী রা.)
  • দুই কিবলাকে ইজ্জত করা(কা’বা ও কুদস)
  • দুই পদেরই জানাযা পড়া (নেককার ও ফাসেক)
  • দুই ইমামের পিছেই নামায পড়া (নেককার বা ফাসেক)

এরকম অনেকগুলোর মাঝে একটা হল: ‘খুফফা বা মোটা মোজার (চামড়ার) ‘উপর’ মাসেহ করা’।

এটা আহলুস সুন্নাহ বা নাজাতপ্রাপ্ত দলের একটা খাসলত বা বৈশিষ্ট্য যে তারা বিশ্বাস করে, মোজার ‘উপর’ মাসেহ করলে ওজু হয়ে যায়। অথচ এটা কিন্তু মোটাদাগে আকীদার কোনো ইস্যু না। দীনের একদম যাকে বলে ‘কম’ প্রায়োগিক একটা মাসআলা। ৯৫ ভাগ মুসলিম জানেও না, জানার দরকারও হয় না। অনেকটা নদীমাতৃক বাংলাদেশে তায়াম্মুমের মাসআলার মতই একটা ‘কালেভদ্রে লাগা’ বা এর চেয়েও বিরল একটা বিষয়। কিন্তু যখন অন্য কোন গ্রুপের আকীদা-বিশ্বাসের বিরুদ্ধে নিজের অবস্থান পরিষ্কার করার বিষয় আসে, তখন এরকম একটা বিরল ‘ছোট’ ‘আমল’ও আকীদার পার্থক্য বুঝাতে সামনে আনতে হয়। শিয়া রাফেজীরা মনে করে মোজার উপর মাসেহ বৈধ না। তাদের সাথে আমাদের পার্থক্য দেখাতে এই ‘ছোট বিষয়টা’ও হক-বাতিলের মাপকাঠি হয়ে গেছে। জরুরিয়াত না, আকীদার মত আবশ্যক বিষয় না। কিন্তু ‘আত্মপরিচয়’ যখন উদ্দেশ্য, তখন এটা স্থান পেয়েছে খলীফার বৈধতা ও কিবলার স্বীকৃতির মত বিরাট আকীদা ইস্যুর সাথে একই কাতারে। আত্মপরিচয়ের জন্য খুঁটিনাটি বিষয়ও সামনে চলে আসে। আনতে হয়। নইলে কোনটা আমি আর কোনটা তুমি তা স্পষ্ট হয় না। নিজের অবস্থান, নিজের ঈমান-আকীদা স্পষ্ট করতে এমন খুঁটিনাটি বিষয় সামনে ‘আনতে হয়’।

কয়েকদিন আগে খুব আলোচিত একটা বিষয় ছিল কুয়েটে শেষ ক্লাসের দিন বিদায়ী ব্যাচের জোব্বা-রুমাল পরে ক্লাসে আসার বিষয়টা। গণমাধ্যম সোশ্যাল মাধ্যমে হৈহৈরৈরৈ। শেষ পর্যন্ত সোকল্ড লিবারেল ধর্মনিরপেক্ষ ব্যক্তিস্বাধীনতার ফাঁপর নেয়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকেও আমরা দেখলাম নোটিশ জারি করতে যে এ ধরনের সংস্কৃতি-বিরুদ্ধ পোশাক পরা যাবে না। শার্টপ্যান্ট পরিহিতা এক আপুকে দেখলাম বাঙালি সংস্কৃতি শেখাতে। বইয়ের কাজে ব্যস্ত ছিলাম বলে হাত নিশপিশ করলেও লিখতে পারিনি এই অনুভূতিটুকু ছাড়া:

“বুঝলাম, যে পোশাকটা আমি জ্ঞান হবার পর থেকেই আমার নানাকে পরতে দেখেছি, দাদাকে দেখেছি। প্রতিদিন আমার ইমামকে দেখি পরতে। স্কুলে আমার টীচারদের অনেককে দেখেছি। ইসলামিয়াত ছাড়া অন্যান্য সাবজেক্টের টীচারদেরও দেখেছি। প্রতি শুক্রবার শখ করেও অনেক প্রতিবেশীকে পরতে দেখেছি। আজ একজন শার্ট-প্যান্ট পরা নারীর মুখে শুনি, সেই পোশাকটা নাকি বাংলাদেশী কালচারের সাথে অস্বাভাবিক!!!
বিশ্বাস করেন আমি ৯০’স কিড। কেবল এক্স-ফাইলস আর ম্যাকগাইভার ছাড়া বাস্তবে আমি কোনো মেয়েকে শার্ট-প্যান্ট-কোট পরতে দেখিনি”।

তবে আমি ভেবেছিলাম আপনারা রাগবেন। বিষয়টা বুঝবেন। কলকাতা কেন্দ্রিক শিল্প-সাহিত্যাঙ্গন ও সুশীল বাঙালির এই ন্যাক্কারের বিরুদ্ধে আপনারা সাংস্কৃতিকভাবে ফুঁসে উঠবেন। হিন্দুত্ববাদী সুশীল শিল্প-সাহিত্য ও বাঙলার নামে এই কৃত্রিম ব্রাহ্মণ ভাষাকে বর্জন করবেন গণহারে। দুঃখের বিষয় দীনসচেতন বহু ভাইও বাঙলা একাডেমির প্রমিত বানানের নামে ‘আরবি শব্দকে বিদেশী শব্দ বানানোর হিন্দুয়ানি প্রকল্প’ আঁকড়ে নিয়েছে। বহু আপাত দীনদার হুজুর-হুজুরাইনকে দেখছি নিজ সংস্কৃতিকে ভুলে যেতে, সংস্কৃতির একচেটিয়া কৃত্রিম হিন্দুকরণ সম্পর্কে গাফেল। সেক্যুলার ইলামবিদ্বেষী সংস্কৃতি পিছে জিভ ঝুলিয়ে ঘুরতে দেখে করুণা হয় খুব। যাক অন্য প্রসঙ্গে চলে যাচ্ছি।

জোব্বা-পাগড়ি-টুপিকে অনেক প্র্যাক্টিসিং মুসলিমও ‘ইসলামী পোশাক’ বলতে নারাজ। অনেক ভাইয়ের মতে ইসলামী পোশাক বলে কিছু নেই, যেকোন পোশাকই ইসলামী পোশাক যদি তা ইসলামের শর্ত পুরো করে। ঠিক আছে মানলাম। কিন্তু…

  • নবীজী যে এই পোশাকটা পরেছেন ও পরতেন তা তো মিথ্যে না।
  • সাহাবীরা, চার খলিফা এই পোশাকটা পরতেন, এটুকু তো ঠিক।
  • উম্মাহর শ্রেষ্ঠ মানুষগুলো, আল্লাহর সবচেয়ে প্রিয় সনদপ্রাপ্ত লোকগুলোর পোশাক তো এটাই ছিল
  • জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত ১০ তারকার পোশাক তো ছিল এটাই
  • আহলে বাইতের পোশাক তো এটাই ছিল
  • যুগে যুগে ইমাম, মুহাদ্দিস, মুজাহিদীন, মুসলিম সুলতান, বিজ্ঞানী সবার পোশাক কী ছিল?
  • আরবভূমি ছাড়া স্পেন থেকে কাশগড় পর্যন্ত যত অনারব মনীষীর ছবি-ভাস্কর্য দেখা যায়, দেখেন তো। অনারব মুসলিমদের পোশাকও তো এটাই পাওয়া যায় ইতিহাসে।
  • আমাদের দাদা-নানা, অনেক স্কুল টীচার, মসজিদের ইমাম-মুয়াজ্জিন, গ্রামের বয়োজ্যেষ্ঠরা, কী পরেন।

সেই পোশাকটাকে যখন কলকাতা-কেন্দ্রিক কৃত্রিম চাপিয়ে-দেয়া কোনো কালচার ‘বিদেশী’ বলে ডিজ-ঔন করতে চায়, নোটিশ দিয়ে নিষেধ করে, মেমসাহেবকে দিয়ে টিটকারি করায়। তখন আমার অবুঝ মন আপনাদের কাছে একটা নীরব প্রতিবাদ আশা করেছিল। মেসির ফ্যান মেসির জার্সি পরে। বাংলাদেশ টীমের সাপোর্টার বাঘের ছবিঅলা টীম জার্সি পরে মাসজিদে আসে রহমতের ফেরেশতা খেদাতে। নিচে ফুলহাতা উপরে হাফহাতা টিশার্ট পরে বলিউড-ফ্যান। আমার আপনার নবীপ্রেম-সাহাবা-প্রেম, ইসলাম-প্রেম কি এখনও মেসি-ক্রিকেট-বলিউড প্রেমের পর্যায়ে পৌঁছায়নি, নাকি? নবী-সাহাবীরা অতটুকু ভালোবাসারও হকদার হননি, নাকি? আমি ভেবেছিলাম আপনাদের হয়ত গায়ে লাগবে।

এসব বকে আর কী হবে। চলে যাই প্রথম কথাটায়। ধরে নিচ্ছি ইসলামী পোশাক বলে কিচ্ছু নেই। নেই মানে নেই-ই। জায়েয-ই করছি, ম্যালা উপকার করছি ইসলামের। তারপরও যখন সেক্যুলার বাম হিন্দুত্ববাদী সংস্কৃতি চ্যালেন্জ করে, তখন এই ছোট্ট অপাংক্তেয় বিষয়টাই আমার আকীদার ইস্যু, আত্মপরিচয়। আমার অবস্থান, আমার ঈমান-আকীদার স্পষ্টীকরণে এটা আর ছোট মামুলি নগণ্য নেই, এটা আমার ভালোবাসা, আমার সংস্কৃতি, আমার উম্মাহ-সত্তার পরিচয়, আলামত। হতে পারে অন্যসময় এটা বড় কিছু না, বা কিছুই না। কিন্তু এখন এটা অনেক কিছু। যখন তুমি আমার পরিচয়কে হুমকির মুখে ফেলছো, তখন আমি আরও জোরে গায়ে পেঁচিয়ে নেব আমার পরিচয়। তোমার বৃটিশ-আশ্রিত হিন্দু-তোষণের কৃত্রিম সংস্কৃতি যখন আমার হাজার বছরের স্বতঃস্ফূর্ত আবেগ-প্রোথিত সংস্কৃতিকে চ্যালেন্জ করবে, তখন আমি নিলাম তোমার চ্যালেন্জ। যদিও এতদিন এটা আমার কাছে কিছু ছিল না, এখন এটা আমার ভালোবাসা। এটা আমার ভালোবাসার মানুষদের পোশাক। এবং আমি এটা ঔন করি। তাই আমি এটা ডিফেন্ড করি।

আমি ভেবেছিলাম, আপনারা হয়ত এটার প্রতিবাদ কমপক্ষে এভাবে করবেন। যারা পোশাকটাকে অপ্রয়োজনীয় ভাবতেন, তারা মাঝেমধ্যে পরা শুরু করবেন। যারা মাঝেমধ্যে পরতেন, গায়রত থেকে অধিকাংশ সময় পরা শুরু করবেন। যারা অধিকাংশ সময় পরেন, তারা সবসময় পরা ধরবেন। যারা সবসময় পরেন, তারা পাগড়িসহ পরা শুরু করবেন। ভেবেছিলাম আমাদের গায়রতে লাগবে। ‘প্রকাশ’ গুলো আরও বেশি আঁকড়ে ধরুন। আইডেন্টিটি পলিটিক্সে সিম্বল খুব খুব গুরুত্বপূর্ণ। যতটুকু এখন আছে, তার চেয়ে বাড়িয়ে দিন। দাড়ি ছোট থাকলে ছেড়ে দিন। শার্ট পরতে হলেও মাথায় টুপি রাখুন সবসময়। বাধ্য না হলে পাঞ্জাবি-জোব্বা আপনায়ে নিন। ঔন করুন। সবকিছু কি ফরজ-ওয়াজিব করে দিতে হবে? ভিতর থেকে কিছু বিষয় আসা দরকার না?

, ,

Leave a Reply