কোনো বিষয়েই জ্ঞান নেই, আইটি বিষয়ক আড্ডার সময় তো বোবা হয়ে চেয়ে থাকি। কবে যেন হোয়াটস-অ্যাপ কাদেরকে যেন ডেটা দিয়ে দিচ্ছিল, সেদিন ‘মেটা-ডেটা’ শব্দটার সাথে পরিচয়। মানে হল— ডেটারও ডেটা (data that describes other data)। যেমন ধরেন, যেকোনো একটা ফাইল একটা ডেটা। আর ফাইলটার author, date created, date modified, file size— এইসব ভিতরের খবর হইল মেটাডেটা। আপনার ফেসবুক আইডিটা যদি আপনার ডেটা হয়, আর ‘কখন’ ‘কোথায়’ আপনি আইডিতে লগ-ইন করেছেন, ইমেইল-পাসওয়ার্ড-হ্যানত্যান এগুলা হল মেটাডেটা। ৩০ দিনের মেটাডেটা থেকে জানা যাবে আপনি দিনের কখন কোথায় থাকেন। আজকের দিনে কখন কোথায় থাকবেন, সেটা আন্দাজ করেও ফেলা যাবে। এরপর একদিন একটা শব্দ শুনলাম— ‘মেটাপলিটিক্স’। পলিটিক্স হল ‘শক্তি অর্জন’ বা ‘ক্ষমতা অর্জন’, আর মেটাপলিটিক্স হল political dialogue about politics itself. ধরেন, ইসলামপন্থী এক্টিভিস্টরা পলিটিক্যাল পাওয়ার অর্জন করতে চাচ্ছে। এজন্য তারা যা যা করতে যাচ্ছে, সে বিষয়ক আলাপ-আলোচনা হল মেটাপলিটিক্স। ধরেন,
- তারা অনলাইন এক্টিভিটি করবে,
- বইপত্র-অনলাইন মিলিয়ে থিওরেটিক্যালি এবং তাবলীগের দ্বারা মাঠে গণমানুষের ওয়ার্ল্ডভিউ বদলানোর চেষ্টা,
- উদাসীন আম-পাবলিকের মাঝে দর্শনগত মেরুকরণের চেষ্টা করবে,
- নিজেদের একাডেমিক দ্বারা ভার্সিটিগুলোয় অবস্থান বানাবে,
- বিদ্যমান ডিসকোর্সকে চ্যালেঞ্জ করে পালটা ডিসকোর্স তৈরি করবে,
- গণ-ইস্যুতে সামাজিক কার্যক্রম (ত্রাণ-সাদাকা) বাড়াবে।
এইসব নিয়ে আলোচনা হল মেটাপলিটিক্স। পলিটিক্স নিয়ে পলিটিক্স।
মেডিকেলের বইগুলো বস্তাবন্দী করে বক্সখাটের তলায় ঢুকোনো ২ বছর ধরে। ক’দিন হলো খাদীজার মা খুব করে ধরেছে, এবার আপনাকে এমডি (doctor of medicine, ডাক্তারদের পিএইচডি আর এমফিলের মাঝে কিছু একটা) ভর্তি পরীক্ষা দিতেই হবে। দিচ্ছি-দিবো করে করে ৪-৫ বছর কাটিয়ে দিয়েছি। তার ধারণা, হাড্ডাহাড্ডি এই লড়াইয়ে আমার নাকি দিনে ১ ঘণ্টা পড়লেই হবে, বউরা স্বামীদের যেমন সুপারম্যান মনে করে আরকি। তার কথা হল, দিনে সেই ৪-৫ ঘন্টা তো পড়িই হাবিজাবি, ১ ঘন্টা পরীক্ষার পড়া পড়লে কী সমস্যা! খাটের তলা থেকে বই বের করার নাম করে আরও মাসখানেক কাটিয়ে দিলাম। সেদিন দেখি বুয়াকে নিয়ে তিনি নিজেই সেই বস্তা খাট খুলে বের করেছেন। পুরো পড়ার ঘর গুছিয়ে তকতকে করে দিয়েছেন। এরপর ঠেলে ধাক্কিয়ে আমাকে দিয়ে একটা রুটিন করিয়েছেন। এই যে ধরেন লেখালেখি করি, বইটই লিখিটিখি। পড়ালেখা বাবদ দিনে ৪-৫ ঘন্টা দিতে হয়। ওদিকে সে একই সাথে দুটো বাচ্চা পালে, একবার ডাকেও না, সাহায্যও চায় না। বলেও না, গেদু মাওলানাকে একটু ধরেন, ওটাকে একটু খাওয়ান। তার চোখে ‘অকাজের পড়া’র সময়ই কিছু বলে না, ‘কাজের পড়া’ শুরু করলে তো আরও বলবে না। পরীক্ষা দিতে যাবো যেদিন, আমি জানি ব্যাগভর্তি ইস্ত্রি-করা কাপড় না চাইতেই পেয়ে যাবো। পরীক্ষায় যদি টিকে যাই, সকল অভিনন্দন জুটবে আমার, তার কথা কেউ বলবে না। ভাবের উদয় কেবল শেষ হল। এবার যাবো ৩৩ বছর পিছনে। ৩৩ বছর কাটলো, কেউ কেউ কথা রেখেছে।
গত ৩৩ টা বছর একজন নারী আমার জন্য দিনরাত এক করেছে। পেশাবের মধ্যে পাঠিয়ে আমি শুকনো বিছানা পেয়েছি। মাসের পর মাস না ঘুমিয়ে পার করতে বাধ্য করেছি। ভাত খাবার সময় প্রতিবেলায় তার ধৈর্যের বাঁধ চুরমার করে দিয়েছি। তাও আমার প্রয়োজনীয়টুকু আমাকে গেলানোর পর তার অবসর মিলেছে। আমার অসুখে সে অসুস্থ হয়েছে, আমার খুশি তাকে হাসিয়েছে৷ প্রতিদিন স্কুলে-কলেজে যাবার সময় ধোয়া- ইস্ত্রি করা জামা পেয়েছি। বাবা মারার সময় সে কোলে টেনে আগলে দাঁড়িয়েছে। মা, চা খাবো। মা, টাকা লাগবে, বেড়াতে যাবো। মা, খাইয়ে দাও, সময় নেই। মা, কাল সকালে খিচুড়ি রান্না কইরো। মা, আজ বিরানি খাবো। সবাই দেখে আমি গোল্ডেন পেলাম, আমি ডাক্তার হলাম, আমি বিসিএস-এ টিকলাম, আমি বই লিখলাম, আমি হ্যানত্যান করলাম। আর আমি দেখি এই মেধা, এই মনন, এই চিন্তাশক্তি, এই স্মৃতিশক্তি, এই দূরদৃষ্টি, এই সাহস, এই দীনী চেতনা, এই বিশ্লেষণ (যেট্টুকই আছে আরকি)… এক শিক্ষিকা, এক পুষ্টিবিদ, এক চাইল্ড সাইকোলজিস্ট, এক উস্তাযা, এক চাইল্ড এডুকেশনিস্ট, এক ডে-কেয়ার গভর্নেস, এক ম্যানেজার, এক শেফ… এক সর্বেসর্বা অলরাউন্ডারের ইনপুট… একজন ‘অফিসিয়ালি মা’-য়ের তিল তিল করে দেয়া ইনজেকশন। আমি যদি কারিগর হই, খাদীজার মা-দাদী মেটা-কারিগর। কারিগরের কারিগর। অল গ্লোরি গোজ টু দেম।
জানিনা ইসলামের এই জাগরণে কতটুকু অবদান রাখতে পারছি। হয়তো কিছুই না। তবে সেই সাহাবী-তাবেঈ থেকে নিয়ে যারা বড় বড় অবদান রেখেছেন, বর্তমান থেকে নিয়ে সালাফদের যুগ অব্দি, সবার ক্ষেত্রেই গল্পগুলো একই। লক্ষ লক্ষ মেটা-কারিগর জন্ম দিয়েছে, বুকের উষ্ণতায় চেপে বড় করেছে, কোলেকাঁখে করে শিক্ষা দিয়ে মানুষ করেছে, দীনী চেতনা বুকে ভরে দিয়েছে লক্ষ লক্ষ কারিগরকে। এভাবেই সভ্যতার কারিগরদের তৈরি করেন মেটা-কারিগররা। এভাবেই ফাতিমারা তৈরি করেন হাসান-হুসাইনদের, বিকশিত করেন আলীদের। রাদিয়াল্লাহুম আজমাঈন।
দেখেন, গত ২০০ বছর পশ্চিমা সভ্যতাকে চ্যালেঞ্জ করার মতো কোনো সভ্যতা গড়ে ওঠেনি৷ কেননা, উপনিবেশের মওকায় মেটা-কারিগরদেরকে কারিগরে নামিয়ে দেয়া হয়েছে। ফলে কারিগর বানানোর লোক নেই, যাদের হাতে প্রতিদ্বন্দ্বী সভ্যতা গড়ে উঠবে। ফাতিমারা তাদের রোল প্লে করা বাদ দিয়েছে, মেটা-কারিগরের ভূমিকাকে তুচ্ছ মনে করেছে। আর আলী তৈরি হয় না, হয় না হাসান-হুসাইন। হাসান-হুসাইন তৈরির ফুল-টাইম ওয়ার্ককে ‘সামান্য’ কাজ মনে করছে। বুয়ার হাতে, অর্ধশিক্ষিত মাস্টারের হাতে, খৃষ্টান মিশনারীর হাতে হাসান-হুসাইনদের গড়তে পাঠাচ্ছে আজ। আলী-রা বাইরে খেটে অবসন্ন দেহে ঘরে ফিরে পায় একই রকম ক্লান্ত এক ফাতেমাকে। কে তার স্ট্রেস ভুলিয়ে তৈরি করে দেবে পরের দিনের যুদ্ধের জন্য। কে হাতে যাঁতা ঘুরানোর ফোস্কা আর পিঠে পানি তোলার রশির দাগ নিয়ে আলীকে বলবে: “যাও খলিফা, লাগবে না আমার খাদেম, দীনের জন্য খরচ করো, নিশ্চিন্তে দীন বুলন্দ করো, আমি যেভাবে পারি সামলে নেব ভিতরে”। আলী-দের বুক আজ দিনমান দুরুদুরু, না জানি ফাতিমাটা কোন কলিগের সাথে হেসে গলে পড়ছে, না জানি কী হল। আর আলী তৈরি হবে না, হবে না হাসান-হুসাইন। যদ্দিন ফাতিমা-রা সভ্যতা গড়ার কাজটা না বুঝে নেয়। সভ্যতা বিনির্মাণে নিজের অংশটা না চিনে নেয়। এই বিশাল কাজ, এই অবিকল্প দায়িত্বের কদর না করে। সভ্যতার সৈনিক হিসেবে তার মূল কাজটা (যার বিকল্প একমাত্র সে-ই) মাদরাসার মিম্বরে নয়, জাজের চেয়ারে নয়, সিইওর অফিসে নয়, মোবাইল কোর্টের ম্যাজিস্ট্রেসিতে নয়, প্রফেসরের ডায়াসে নয়। এসব জায়গায় তার বিকল্প অনেক পুরুষ আছে। যেখানে তার বিকল্প হয় না, সেই হাপর-হাতুড়ি আজ বন্ধ, অস্ত্র তৈরি করবে কে?
এরমানে এই না, নারীরা বাইরে কিছুই করবে না। কোনো কোনো বেহেন বলেন, নারীরা গণহারে প্রোফেসর, জাজ, টীচার, পলিটিশিয়ান, পাইলট, সাংবাদিক, ডাক্তার ইত্যাদি না হলে ইসলামের সুদিন ফিরবে না। এই রোলগুলো কারিগরের রোল, এগুলো করার জন্য যথেষ্ট পুরুষ রয়েছে। যোগ্যতাসম্পন্ন নারীরা ইসলামের সীমায় ‘নারীরই প্রয়োজনে’ শিক্ষিকা-ডাক্তার হয়েছেন। কিন্তু পুরুষের কাঁধে কাঁধ সবখানে মেলাতে গিয়ে আসল-বিরাট-মূল-প্রধান ভূমিকায় অবহেলা-কম্প্রোমাইজ-প্রক্সি-জোড়াতালি সভ্যতার উন্নতি দূরে থাক; বরং সভ্যতার আত্মহত্যা। অস্ত্রের কারিগর অস্ত্রই বানাতে হয়… নিজে যুদ্ধে যাবার চেয়ে সেটা তার বেশি প্রয়োজন।
শ্রেষ্ঠ ৪ নারী: খাদীজা, মারইয়াম, আসিয়া, ফাতিমা। কেন শ্রেষ্ঠা? জাজ, টীচার, পাইলট, ডাক্তার বলে? মেটা-কারিগর বলে। স্বামী-সন্তানদের কারিগর হবার কারণে তারা শ্রেষ্ঠা। ফাতিমা রা. কেন জান্নাতের নারীদের সর্দার? কেননা, তার ভূমিকাটাই উম্মাহর নারীদের মূল ভূমিকা৷ আর তিনি তা শতভাগ করে দেখিয়েছেন। আয়িশা রা. এর ইলমী খেদমত উম্মতের প্রয়োজন সাপেক্ষ। আকরাম নদভী শায়েখের বইয়ে ৮০০০ নারী মুহাদ্দিসা উম্মতের নারীদেরই প্রয়োজন সাপেক্ষ (পুরুষেরাও সনদ নিয়েছেন তাদের দীর্ঘ হায়াত ফলে শর্ট সনদের জন্য)। কিন্তু ফাতিমা রা. এর ভূমিকাটাই মূল অফিসিয়াল কাজ, যার সাথে কম্প্রোমাইজ চলে না। ৮০০০ মুহাদ্দিসার বিপরীতে লক্ষ লক্ষ মেটা-কারিগর যে ভূমিকাটি পালন করে অস্ত্রের লাগাতার যোগান দিয়েছেন। লক্ষ লক্ষ আলী-হাসান-হুসাইন সাপ্লাই দিয়েছেন।
আচ্ছা ধরেন, বিখ্যাত মুহাদ্দিসা কারীমা মারওয়াজিয়া (মার্ভ-শহরনিবাসী)-র খেদমত উম্মাহর জন্য বেশি প্রভাবশালী নাকি ইমাম বুখারীর মায়ের খেদমতটা। কারীমা রহ. এর নামটা আমরা জানি, কিন্তু ইমাম বুখারীর মায়ের নামটা আমরা জানি না, এই তো? কিন্তু উম্মাহকে এগিয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে এই অচেনা মহিলার যে অবদান, তার তুলনা করা যায় কারীমা রহ. এর সাথে? কারীমা যা করেছেন, তা করার জন্য হাজারো পুরুষ আছে। ইনফ্যাক্ট কারীমার কোনো অবদানই তেমন চোখে পড়ে না পুরুষ মুহাদ্দিসদের ভিড়ে। কিন্তু ইমাম বুখারীর মায়ের অবদানটা কোনো পুরুষের পক্ষে সম্ভব ছিল? প্রশ্ন রেখে গেলাম। যদি উম্মাহর জন্যই কাজ করার থাকে, তাহলে আমাদের মেয়েদে কোনটায় আত্মনিয়োগ করা উচিত।
দুআ করিয়েন আপনারা, খাদীজার মা-দাদী যেন পরীক্ষায় টেকে (টিকেছে আলহামদুলিল্লাহ)। আর খাদীজার দুনিয়ার তাবৎ খালামণি, পিপি (ফুপি) ও দাদীআপুদের লাখো সালাম।
সভ্যতার মেটা-কারিগরদের বিপ্লবী সালাম।