আমি যে মাঝেমধ্যে বলি:
প্রত্যেক নারীবাদী, প্রত্যেক বিজ্ঞানবাদী, প্রত্যেক নাস্তিক ইসলামবিদ্বেষী, প্রত্যেক লিবারেল মিশনারী মূলত নব্য-উপনিবেশবাদ ও নব্য-সাম্রাজ্যবাদের দালাল।
আপনারা মনে করেন আমি বেশি বেশি বলতেসি। নিচের পিকের সাথে মিলিয়ে নিয়েন।
ইমানুয়েল কান্ট
পশ্চিমা জীবনাদর্শের ভিত্তি এনলাইটেনমেন্ট। তাদের আদর্শের নির্মাতা এই এনলাইটেনমেন্ট যুগের দার্শনিকেরা। জার্মান আলোকায়ন যুগের মূল ব্যক্তিত্ব হলেন কান্ট। তাঁর বিখ্যাত Theory of Race দৃষ্টিভঙ্গির দরুন কান্ট ও তাঁর অনুসারীদের যুক্তি হলো, পুরো বিশ্বের সভ্যকরণ শক্তি (civilizing force) হলো ইউরোপ। এবং আফ্রিকান ও নেটিভ আমেরিকানরা শাসিত হওয়ারই যোগ্য। [১]
জন লক
ব্রিটিশ চেরাগায়নের পুরোধা বলা হয় জন লক-কে। তাঁকে লিবারেলিজমের জনক বলা হয়, বস্তুবাদের জনক বলা হয়। তিনিই বলেন: জীবন, স্বাধীনতা ও সম্পত্তি হলো ‘ডিভাইন রাইটস’। রাজতন্ত্রের পরিবর্তে তিনি সর্বপ্রথম ‘জনগণের সরকার’-এর কথা বলেন। স্বাধীনতা-সমতা তথা লিবারেলিজমের এই জনক
- নিজে একাধিক দাসব্যবসা কোম্পানির শেয়ারহোল্ডার ছিলেন।
- ব্রিটিশ কলোনিগুলোতে দাস সাপ্লাইয়ের জন্য Royal Africa Company গঠিত হলে তিনি এরও অংশীদার হন। ১৬৭৪ ও ১৬৭৫ সালে দুইবার বিনিয়োগ বৃদ্ধি করেন।
- তিনি আমেরিকার ক্যারোলিনা রাজ্যের Lords Proprietors-এর সেক্রেটারি ছিলেন। সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে কলোনিয়াল প্রশাসক ছিলেন। [২]
- ক্যারোলিনা রাজ্যের সংবিধানের রচয়িতাদের একজন ছিলেন লক, যেখানে আইন ছিল:
Every Freeman of Carolina shall have absolute power and authority over his negro slaves (ক্যারোলিনার প্রত্যেক স্বাধীন মানুষ তার নিগ্রো দাসদের ওপর চূড়ান্ত কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা ধারণ করবেন) [৩]
Locke, ‘The Fundamental Constitutions of Carolina, 196
হেগেল
পাশ্চাত্য দর্শনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ দার্শনিক Georg Wilhelm Friedrich Hegel (১৭৭০-১৮৩১) ছিলেন এই বর্ণবাদ, দাসপ্রথা ও উপনিবেশবাদের একনিষ্ঠ সমর্থক। হেগেলের মতে, স্বাধীনতার চর্চা কেবল হতে পারে ক্ল্যাসিকাল ইউরোপে (গ্রেকো-রোমান), খ্রিস্ট ইউরোপে এবং আধুনিক ইউরোপে। বাকি দুনিয়ার ক্ষেত্রে যদি ইউরোপ তার সভ্যতা আরোপ করে, তাহলে স্বাধীনতা প্রযোজ্য হবে।
ইউরোপীয়দের আমেরিকা দখল ও দাসব্যবসা এ কারণে জাস্টিফায়েড যে, তারা ফ্রিডম শেখাতে গিয়েছে। ফ্রিডম হলো self-determination, নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নেওয়া। নিজেই যুক্তি দিয়ে ঠিক করা যে, আমি কী অনুসরণ করব, কোন প্রবৃত্তি পুরা করব। ইউনিভার্সাল কোন নীতি মেনে চলব, নাকি চলবো না। (HG 148–49).এই সামর্থ্য প্রতিটি মানুষের আছে। যেমন: ওরিয়েন্টালরা (মুসলিমরা) এই স্পিরিটের ব্যাপারে জানেইনা, ফ্রিডমের সার্বজনীনতা জানে না, এজন্য তারা unfree.(87; my emphasis).যারা প্রি-হিস্টোরিক ও unfree কালচারে বাস করে তাদেরকে ফ্রিডম বাইরে থেকেই দিতে হয়। [৪]
ভলতেয়ার
নিচের ছবিতে দেখুন ফরাসি এনলাইটেনমেন্টের পুরোধা ভলতেয়ার কী ভাবছেন।
<image>
জন স্টুয়ার্ট মিল
ক্ল্যাসিকাল লিবারেলিজমের আরেকজন বিখ্যাত দার্শনিক মিল। তাঁকে লিখতে দেখা যায়:
” বর্বরদের সাথে আচরণ করার ক্ষেত্রে সরকারের বৈধ পদ্ধতি হলো স্বৈরাচার, এটাই তাদের জন্য হবে উন্নতির কারণ এবং শেষমেশ তাদের জন্য এটাই ভালো বলে এটাই ন্যায়সঙ্গত।… মুক্ত ও সমতাভিত্তিক আলোচনার দ্বারা যতক্ষণ কোনো মানবজাতি উন্নত হয়ে উঠছে না, তার আগ অব্দি কোনো অবস্থাতেই লিবার্টির (স্বাধীনতা) মূলনীতিটি প্রযোজ্য নয়। ততক্ষণ পর্যন্ত একজন আকবর বা শার্লম্যানের বিনাপ্রশ্নে আনুগত্য ছাড়া তাদের জন্য আর কোনো ব্যবস্থা নেই, যদি এমন কাউকে পাওয়া যায়”।
On Liberty,Chapter 1, Page 16
অর্থাৎ যে জাতি উন্নত না, তাদের জন্য লিবার্টির মূলনীতি প্রযোজ্য নয়। এরকম দ্বিমুখী কথাবার্তায় ভরপুর পশ্চিমা একেকজন দার্শনিকের বক্তব্য। তাহলে কখন একটি জাতিকে উন্নত ধরা হবে? তাঁর মতে:
“একটি দেশকে তখনই সভ্য ভাবা হয়, যদি আমরা মনে করি রাষ্ট্রটি উন্নত; মানুষ ও সমাজের সর্বোত্তম বৈশিষ্ট্যে প্রস্ফুটিত; পরিপূর্ণতার পথে আরও আগানো; আরও সুখী, আরও অভিজাত, আরও জ্ঞানী”।
Civilization, John Stuart Mill
তারা কারা? মিল বলেন:
These elements exist in modern Europe, and especially in Great Britain, in a more eminent degree, and in a state of more rapid progression, than at any other place or time. -‘এই বৈশিষ্ট্যগুলোর উপস্থিতি অন্য যে কোনো স্থান বা সময়ের চেয়ে আধুনিক ইউরোপে এবং বিশেষ করে গ্রেট ব্রিটেনে আরও অধিক পরিমাণে আছে। এবং অন্যান্য যেকোনো সময় ও স্থানের চেয়ে দ্রুত উন্নতির অবস্থায় রয়েছে এখানে’।
Civilization, John Stuart Mill
অর্থাৎ ব্রিটিশ বা আধুনিক ইউরোপীয় জাতিগুলোর তুলনায় দুনিয়ার বাকি জাতিগুলোর জন্য লিবার্টির মূলনীতি প্রযোজ্য না। পরাধীন থাকাই তাদের জন্য মঙ্গলজনক। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী লর্ড সিসিল রোডস মিলের থিওরিকেই প্র্যাকটিক্যালি বলেছেন:
নেটিভদের সাথে আচরণ করতে হবে শিশুর মতো। তাদেরকে ভোটাধিকার দেওয়া যাবে না। দক্ষিণ আফ্রিকার বর্বরদের সাথে বোঝাপড়ায় আমাদেরকে গ্রহণ করতে হবে স্বৈরতন্ত্রের নীতি, যেমনটা ইন্ডিয়াতে সফলতার সাথে করা হয়েছে।
The Making of a Racist State: British Imperialism and the Union of South Africa
<image>
অর্থাৎ লিবার্টি-সমতা এগুলো শুধু ‘সভ্য’ জাতির জন্য। তাদের চোখে ‘অসভ্য’ জাতির জন্য এগুলো নয়। আজকের নারীবাদীরা দেখেন একই সুরে কথা বলছে। মুসলিমদের সভ্য করার জন্য ‘লিবারেল সেক্যুলার একনায়কতন্ত্রের’ কথা বলছে। উপনিবেশীদের সুরে, সাম্রাজ্যবাদীদের সুরে কথা বলছে। যেহেতু আমরা পশ্চিমা স্টাইল নারীবাদ মেনে নিচ্ছি না তাই আমরা সভ্য না। যেহেতু পশ্চিমা বিজ্ঞানবাদের কাছে মুসলিমরা আত্মসমর্পণ করছি না, তাই আমরা সভ্য নই। যেহেতু আমরা সেক্যুলার নাস্তিক ধর্মত্যাগী হয়ে উঠছি না, তাই আমরা বিজ্ঞানমনষ্ক নই, আমরা কুসংকারাচ্ছন্ন। আমাদেরকে কঠোর একনায়কতন্ত্রের মাঝে রেখে এডুকেট করতে হবে।
এই ফিফথ কলাম (ঘরের শত্রু) দের শনাক্ত ও মুখোশ উন্মোচন করতে না পারলে দেশের স্বাধীনতা ও তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়ন কোনোভাবেই সম্ভব না, চিরটাকাল ১ম বিশ্বের গোলামি করেই যেতে হবে।
সূত্র:
[১] Three Philosophers on Slavery , Classics of Western Philosophy
[২] Farr 2008, 497–499, for a list of Locke‘s posts and involvement with slavery
[৩] Locke, ‘The Fundamental Constitutions of Carolina, 196
[৪] Alison Stone (Professor of European Philosophy, Lancaster University) Hegel and Colonialism.
বই থেকে: ইসলামে দাস-দাসী ব্যবস্থা
লেখক: ডা. শামসুল আরেফীন
প্রকাশক: মাকতাবাতুল আযহার
<image>