সম্মতি রম্য: পর্ব ৩ (বৈবাহিক ধর্ষণ?)


‘বৈবাহিক ধর্ষণ’… এটা কেবল দুটো শব্দ নয়। ২ শব্দের ভিতর ২টা দর্শন— বিবাহের দর্শন, ধর্ষণের দর্শন। ধর্ষণের দর্শন আমরা আলাপ করেছি আগের পর্বে। যেমন ‘পিল’ শুধুমাত্র একটা ওষুধ না, একটা জীবনদর্শন, একটা লাইফস্টাইল। যেহেতু ‘বৈবাহিক ধর্ষণ’ শব্দটাও একটা পশ্চিমা ধারণা, শব্দটার অন্তর্নিহিত দর্শনও আমাদের পশ্চিমা প্রেক্ষাপটেই বুঝতে হবে। এবং আমাদের প্রেক্ষাপটে সেই দর্শনের উপযোগিতা আলোচনায় আনতে হবে। কোন নৈতিক গ্রাউন্ডে (consent-based model) ধর্ষণ একটা অপরাধ, কিন্তু ব্যভিচার অপরাধ না— সেটা আমরা অলরেডি দেখেছি। এবার আমরা একটু দেখব, পশ্চিমা আধুনিকতায় ‘বিবাহ’ কী (Western philosophy of marriage)?

পাশ্চাত্য বিবাহ-দর্শন:

২য় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে পশ্চিমা সমাজব্যবস্থায় দ্রুত পরিবর্তন আসতে শুরু করে। অর্থনীতি ও সমাজনীতি খুব দ্রুত পরিবর্তন হতে থাকে। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্রের সংঘাত ও প্রতিযোগিতা এই পরিবর্তনের কারণ। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতার জন্য সমাজব্যবস্থাকে উপযোগী করে নেবার জন্য মানুষের ধ্যানধারণা, পরিবার কাঠামো সবকিছু বদলে দেয়া হয়। ফলে পরিবর্তন আসে ‘বিবাহ’-এর ধারণায়ও। যেমন ধরুন, ২য় বিশ্বযুদ্ধোত্তর অর্থনৈতিক লম্ফঝম্পের উদ্দেশ্যে নারীদের ব্যাপকভাবে জবমার্কেটে আনা ও রাখা প্রয়োজন। ৬০-এর দশকে শুরু হল নারীবাদের ২য় ওয়েভ, একই সময় দেয়া হল ‘জেন্ডার-রোল থিওরি’। বাধা মনে হল পরিবার ও সন্তান, ৬০ এর দশকেই এলো ‘পিল’। মিডিয়া তার কাজ শুরু করল। সন্তান ধারণ ও লালন আর রইল না ‘বিবাহের উদ্দেশ্য’। জনপ্রিয় হতে লাগল ‘লিভ-টুগেদার’ কালচার। পশ্চিমা সমাজে বিবাহের আধুনিক ধারণাটা কেমন দেখা যাক—

উপরের চার্ট থেকে বুঝা যাচ্ছে যে, ঐতিহ্যবাহী ‘বিবাহ’প্রথার যে যে উদ্দেশ্যগুলো ছিল, তা বিজ্ঞান-প্রযুক্তির কল্যাণে এবং পুঁজিবাদের বিকাশের দরুন বিবাহ ছাড়াই পূরণের সুযোগ তৈরি হয়েছে। সুতরাং প্র্যাক্টিক্যালি যৌন, আর্থিক, প্রজন্মগত, স্বাস্থ্যগত— কোনো কারণেই আধুনিক সভ্যতার ‘বিয়ে’র দরকার নেই। তাহলে তারা কেন বিয়ে করে?

এটাই পশ্চিমা সভ্যতার আধুনিক বিবাহ-দর্শন। আর তা হল: বিয়ে কেবলই একটা চুক্তি, যেখানে সমান দুজন মানুষ (primarily a personal contract between two equals) মনে করে, তারা একে অপরের সাথে বাকি জীবন কাটাতে সম্মতি দেয়। তারা বিশ্বাস করে এতে তাদের প্রেম-খুশি-স্থিরতা বাড়বে। এবং এই সংজ্ঞা থেকেই সমকামীরাও বিয়ে করে, কেননা বিয়ের এই সংজ্ঞায় তারাও শামিল। যেহেতু সন্তান জন্মদান এই সংজ্ঞায় নেই। প্রবেশন (penetration) তো এখন সেক্সের সংজ্ঞায়ই নেই। সুতরাং ভ্যাজাইনাল সেক্সও বিয়ের এই সংজ্ঞায় নেই। পশ্চিমা বিবাহ-দর্শনে বিশ্বাসীরা ঠিক এই চিন্তাকাঠামো থেকেই প্রাচ্যের ঐতিহ্যবাহী বিবাহ-প্রথা নিয়ে প্রশ্ন তোলে।

CBS News তাদের 60 Minutes and Vanity Fair প্রোগ্রামের মাধ্যমে এক জরিপ করে, বিয়ের উদ্দেশ্য কী— এর উপর—

  • ৫৪% বলেছে: এর উদ্দেশ্য প্রতিশ্রুতিশীলতা (mark of commitment)
  • ২৩% বলেছে: এর উদ্দেশ্য সন্তানের জন্য সুন্দর পরিবেশ দেয়া(provide for raising children)
  • ২০% বলেছে: বিয়ের আদৌ কোনো উদ্দেশ্য আছে বলে মনে হয় না, নিরর্থক।
    সেক্স, সন্তান আনা, মিথোজীবিতা— এসব বিয়ের উদ্দেশ্যের মধ্যেই পড়ে না।

সুতরাং, এই বাস্তবতায় সমান দুজন, যাদের কারও উপর কারও কোনো দাবি নেই, অধিকার থাকবে না। স্রেফ পরস্পরকে মানসিক সুখ দেয়া, কমিটমেন্ট, ভালোবাসা যে চুক্তির উদ্দেশ্য; সেখানে যদি বিন্দুমাত্রও একপক্ষের অসম্মতি থাকে, সে চুক্তি আর প্রাসঙ্গিক থাকে না। এটাই ‘বৈবাহিক ধর্ষণ’-এর ক্যানভাস। ঐ বিশেষ বিবাহ-দর্শনে ঐ বিশেষ অসম্মতির আচরণ (যা চুক্তির আওতাধীন না) তখন অপরাধ হিসেবে পরিগণিত।

পশ্চিমা বিবাহ-দর্শন আরও স্পষ্ট হবে যদি তাদের ডিভোর্স-দর্শনটা একটু টেনে আনা যায়। ১৯৬৯ সালে ক্যালিফোর্নিয়া রাজ্যে প্রথম পাশ হয় no-fault divorce আইন। যদি উভয়ের যে কারও বিবাহ কন্টিনিউ করতে ইচ্ছে না করে, সে নো-ফল্ট ডিভোর্স দিতে পারে, যেখানে সঙ্গী/সঙ্গিনীর কোনো দোষ উল্লেখের প্রয়োজন নেই। অধিকাংশ পশ্চিমা দেশেই এই আইন রয়েছে। ১৯৭৫ সালে অস্ট্রেলিয়াও এই আইন করে। তাদের বিবাহ-দর্শনে কোনো দায়বদ্ধতা, কোনো স্বার্থত্যাগ, সন্তানের দিকে চেয়ে কোনো কম্প্রোমাইজের কোনো বিষয় নেই। পাশ্চাত্য ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী দর্শনের অনিবার্য ফল এসব আইন।

ইসলামের নিকাহ

বিপরীতে ইসলামের বিবাহ-দর্শন ভিন্ন। ইসলামে বিয়েকে বলা হয় নিকাহ (نكاح), বা তাযবীজ (تزويج) । যার আভিধানিক অর্থ হল: মিলন (union), জোড়া সৃষ্টি করা (pairing)। নিকাহের প্রধানতম উদ্দেশ্যই যৌনমিলন। যৌনতা মানুষের একটি মৌলিক প্রয়োজন। এটি পূরণও হতেই হবে, আবার একই সাথে একে নিয়ন্ত্রণও করতে হবে। এই চাহিদা পূরণ ও একইসাথে নিয়ন্ত্রণের বিধিবদ্ধতা হচ্ছে নিকাহ, যার উদ্দেশ্যই দুই লিঙ্গের union-কে বৈধ করা। যার এই ক্ষমতা নেই, তার জন্য নিকাহ হারাম, যেমন: পুরুষত্বহীন পুরুষ। [1]

সুতরাং যৌনমিলন হচ্ছে নিকাহের প্রধানতম উদ্দেশ্য। এটা পশ্চিমা marriage-এর সাথে নিকাহ-এর প্রধানতম পার্থক্য। যৌনমিলন সম্ভব না হলে, নিকাহ (union) নিরর্থক। একজন স্বাধীনা নারীর যৌনাঙ্গ একজন পুরুষের জন্য বৈধ হবার আইনী ভিত্তি— নিকাহ। পশ্চিমা সভ্যতায় এই ভিত্তি হল সম্মতি, আর আমাদের হল নিকাহ।

সুতরাং, নিকাহ-কেন্দ্রিক অন্যান্য বিধানাবলীও এই যৌনমিলনকে কেন্দ্র করে গঠিত। যেমন, যদি ‘মাহর’ বা compulsory marital dower নিয়ে আলোচনা করি তাহলে এই উদ্দেশ্য আরও স্পষ্ট হয়। ইসলামে নিকাহের সাথে মাহর বা মোহরানা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মাহরের আলাপটা আমাদেরকে নিকাহ ও সেক্স-এর মাঝে কী সম্পর্ক তা বুঝতে সাহায্য করবে।

মাহরের ধারণা

‘মাহর’ (compulsory marital dower given to wife by husband ) নগদ অর্থ হতে পারে, গহনা হতে পারে, কোনো বস্তু হতে পারে। হানাফী মাযহাব মতে সূরা শিক্ষা ইত্যাদি দ্বারা হবে না। এমন কিছু হতে হবে যার বিনিময়মূল্য আছে। এবং কমপক্ষে ১০ দিরহামের নিচে মাহর হবে না। [হিদায়াহ, ২/৩৭] এবার দেখেন:

  • হাদিসে এসেছে: ‘…স্বামী তার সাথে সহবাস করলে তাতে সে মাহরের অধিকারী হবে [আবু দাউদ ২০৮৩, তিরমিযী ১১০২. ইবনু মাজাহ ১৮৭৯, ১৮৮০] যদি বিয়ের সময় মাহরের পরিমাণ নির্ধারণ না-ও করে, বিয়ে consummate করার সাথে সাথে স্ত্রী মাহর প্রাপ্য হবে। এই consummate অর্থ ‘স্বামী-স্ত্রী একান্ত হওয়া’ (private secclusion) । উমার রা. বলেন: ‘পর্দা টেনে দিলে বা দরজা বন্ধ করলেই পূর্ণ মাহর ওয়াজিব হবে’। এটাই মালিকী ছাড়া বাকিদের অভিমত।
  • উকবা ইবন আমির (রাঃ) থেকে বর্ণিত: রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেছেন, শর্ত (চুক্তি)-সমূহের মধ্যে সর্বাধিক প্রতিপালনীয় গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হচ্ছে, তোমরা যা দ্বারা (মহিলার) লজ্জাস্থান হালাল করবে, (অর্থাৎ মোহর আদায় করা)। [সুনানে আন-নাসায়ী নিকাহ্‌ ৩২৮১] মাহর নির্ধারণ না করলেও সহবাসের পর স্ত্রী মাহর প্রাপ্য এবং ওয়াজিব, যদি না স্ত্রী দাবি ত্যাগ করে। মাহর পরিশোধ না করে স্বামী মারা গেলে তার সম্পত্তি থেকে অন্যদের দেনা শোধের আগে শোধ করতে হবে স্ত্রীর মাহর।
  • ইবনু যুহরী (র) থেকে বর্ণিতঃ আবদুল মালিক ইবনু মারওয়ান জবরদস্তিভাবে যিনা করা হয়েছে এমন স্ত্রীলোকের ফয়সালা এই দিয়েছেন: ধর্ষণ যে করেছে, সে ঐ স্ত্রীলোকটিকে মোহর দান করবে। (এরপর হদ কায়েম হবে) ইমাম মালিক (র) বলেন আমাদের নিকট এই ফয়সালা যে, যদি কেউ কোন স্ত্রীলোকের উপর জবরদস্তি করে, চাই সে কুমারী হোক অথবা অকুমারী, যদি সে স্বাধীনা হয়, তবে তাকে মাহরে মিসাল দেয়া আবশ্যক। [মুয়াত্তা ইমাম মালিক ১৪১০] (ইখতিলাফ আছে, স্রেফ ধারণাটা বুঝার জন্য, মাসয়ালা বলা উদ্দেশ্য না)
  • যদি স্বামী সহবাস না করেই বা পরিপূর্ণ একান্ত না হয়েই তালাক দেয়, তাহলে অর্ধেক মাহর কাটা যাবে, যেহেতু সহবাস করা হয়নি।
  • আলিমগণ এ ব্যাপারে একমত যে, মাহর পরিশোধের আগ পর্যন্ত স্ত্রী চাইলে সহবাসের অনুমতি না-ও দিতে পারে। কিন্তু একবার অনুমতি দিয়ে ফেললে, আর অনুমতি স্থগিত করতে পারবে না। শুধু ইমাম আবু হানিফা রহ. বলেন, প্রত্যাখ্যান করতে পারবে। সাহেবাইনের মতে পারবে না।
  • অধিকাংশ আলিমগণের মতে (হানবালি ছাড়া বাকিদের মতে), মাহর নেবার পর যদি স্ত্রী সহবাসে অসম্মতি জানায় (শারঈ কারণ ছাড়া), তাহলে স্বামী মাহর ফেরত চাইতে পারবে। (Maqsad al-nabih, M ajma ‘ al-‘anhur and al-Fiqh ‘ala al-madhahib al-‘arba’ah) এবং স্ত্রী ভরণপোষণ পাবার অধিকার হারাবে
  • যদি বাতিল বিবাহ (যা বিবাহ হয়নি, যেমন ৫ম স্ত্রী) করে এবং সহবাস করে, তবে বিয়েটা বৈধ না হলেও সহবাসের কারণে মাহর ওয়াজিব হবে

মাহরের আলোচনাটুকু এজন্য করা হল, নিকাহ, সহবাস ও মাহর উভয়ের ওতপ্রোত হওয়াটা বুঝানোর জন্য। এবং মাহর নির্ধারণ ছাড়া নিকাহ অনুষ্ঠিত হয়ে যাবে ঠিকই, কিন্তু ‘একান্ত হওয়া বা সহবাস করা’র সাথে সাথে পূর্ণ মাহর ওয়াজিব হয়ে যাবে। আগেই ধার্য করে না নিলেও সহবাসের সাথে সাথে ‘মাহরে মিসিল’ (তার বংশের অন্যান্য মেয়েদের সমপরিমাণ মাহর)-এর হকদার স্ত্রী হয়ে যাবে, যা পুরুষের উপর ওয়াজিব।

মাহরের দ্বারা স্ত্রীর যৌনসম্মতি প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। মাহরের প্রতীকী বিনিময়ে স্ত্রীর শরীরের উপর স্বামীর আইনী অধিকার প্রতিষ্ঠা হয়। শিক্ষককে আপনি যত টাকাই দেন, সেটা তাঁর দেয়া ‘শিক্ষার’ মূল্য হয় না, সেটা সম্মানী হয়, Token of respect হয়। মাহর-ও তেমনি স্ত্রীর Token of respect, যা শুধু স্ত্রীরই নিজের, সে যেভাবে ইচ্ছে বৈধপথে খরচ করবে

এজন্য পরিভাষার গুরুত্ব এতো ব্যাপক। পশ্চিমা marriage বা বিবাহে ধর্ষণ হতে পারে, আমাদের ‘নিকাহ’-তে ধর্ষণ বলে কিছু নেই। আমরা মুসলিমরা ‘marriage’ বা বিয়ে করি না, আমরা নিকাহ করি।

এবং ইসলামের বিবাহ-দর্শনে (নিকাহ) ‘বৈবাহিক ধর্ষণ’-এর কোনো স্থান নেই। এটা কোনো খেয়ালখুশি না যে, যা মনে চাইল তা-ই করলাম। একে বলে ‘আকদ’ (عَقْد), যার অর্থ চুক্তি, মতৈক্য, বন্ধন ইত্যাদি। যেকোনো চুক্তির ফলে উভয় পক্ষের উপর পরস্পর দায়বদ্ধতা থাকে, পরস্পরের উপর অধিকার থাকে, কর্তব্য থাকে, চুক্তি পূরণের প্রতিশ্রুতি থাকে, চুক্তি রক্ষার চেষ্টা থাকে। যখন খুশি বিনা উস্কানিতে চুক্তি বাতিল করে দেয়া গেলে, তা কোনো চুক্তিই নয়। বিবাহ নারী-পুরুষের মাঝে এমন বন্ধন তৈরি করে যা শুধু বস্তুবাদী বা শুধু ভাবের দৃষ্টিতে নয়, বরং সামগ্রিক দৃষ্টিতে দেখার দাবি রাখে।

এই বন্ধন সমাজ রক্ষা করে। রাষ্ট্র রক্ষার চেষ্টা করে। শরীয়াহ রক্ষা করে—

  • হালাল কাজের ভিতর সর্বনিকৃষ্ট কাজ হল তালাক। (নিরুৎসাহ প্রদান)
  • কোনো নারী যদি বিনা কারণে স্বামীর কাছে তালাক চায়, জান্নাতের সুগন্ধও তার জন্য হারাম। [আবু দাউদ, আলবানী সহীহ]
  • তোমরা আল্লাহর বান্দীদের ব্যাপারে কঠোর হয়ো না। তার একটা জিনিস অপছন্দ হলেও আরেকটা জিনিস পছন্দ হবে। (নারীদের ব্যাপারে সবর করা। একটা জিনিস খারাপ লাগলেই পশ্চিমের মত ডিভোর্সের চিন্তা না করা।)

পশ্চিমা ‘বৈবাহিক ধর্ষণ’ ও ইসলামী পরিবারনীতি

কী কী কারণে ম্যারিটাল রেপ হচ্ছে, এর পেছনে স্বামীর কী সাইকোলজি কাজ করছে, আর সেই কারণগুলো ইসলামী পরিবারনীতি কীভাবে হ্যান্ডেল করে দেখা যাক।

প্রকৃত অর্থে ‘ম্যারিটাল রেপ’ যেটাকে বলা হচ্ছে, যা এই ৫টি কারণে হচ্ছে, বা এই ৫টা সাইকোলজি থেকে স্বামীরা করছে। ইসলামী পরিবারনীতিতে তার কোন স্থান নেই। ইসলাম সেটাকে অবশ্যই নিরুৎসাহিত করে। আরবি নামের যেকোন লোকের অকাজ-কুকাজই ইসলামের পরিচয় না, ইসলামের পরিচয় ইসলামের শিক্ষা। যে ইসলামের শিক্ষা মানে না, তার কাজে ইসলামের কী দায়, সে তো ইসলামের শিক্ষাকে মানেইনি। বরং পরিপূর্ণ ইসলামী দাম্পত্য শিক্ষা না থাকাই নারীর এই কষ্টের জন্য দায়ী। ইসলাম সবাইকে একটা লিমিট দিয়ে দেয়, এর বাইরে গেলে বাড়াবাড়ি, এবং বাড়াবাড়ির হিসেব আল্লাহর কাছে দিতে হবে, আল্লাহ বাড়াবাড়ি করনেওয়ায়ালাদের পছন্দ করেন না। এখন আপনারা তো সেই সীমাটাই জানতে দিচ্ছেন না, আবার সীমা লংঘন করলে ইসলামের দোষ দিচ্ছেন, মানে কী? স্ত্রী যদি মনে করে স্বামী তার উপর জুলুম করছে, তবে অবস্থা সাপেক্ষে ইসলামী আদালতের দ্বারস্থ হবার অধিকারও তাকে দেয়া হয়েছে। কিন্তু তা অবশ্যই রেপ হিসেবে নয়, জুলুম হিসেবে। স্বামী কর্তৃক শুধু যৌনমিলন আমাদের ‘নিকাহ’-এর ধারণায় অপরাধ না। তবে সেটার আগে যে জুলুম করা হয়, সেজন্য ইসলামী আদালত স্ত্রীর পক্ষে ব্যবস্থা নিতে পারে।

কিন্তু ইসলামের শিক্ষাই এমন যে, তা এসব সাইকোলজিকেই এড্রেস করে। স্বামীর সাইকোলজিই জুলুমী হতে দেয় না। ইসলাম হল ব্যালান্স, ভারসাম্য। চোরও ঠেকাব, জিনিসও লুকাব। সোনাদানা বাইরে রেখে চোরের দোষ দেবার ন্যাকামো ইসলামে নেই। বরং ইসলাম এমন সংযম, পরস্পরের জন্য উৎসর্গ ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের শিক্ষা দেয়, যে সফটওয়্যার শুরুতেই ইন্সটল করে দিতে পারলে, আপনাদের তথাকথিত ‘ম্যারাইটাল রেপ’ হবার কোন সুযোগই নেই।

ইসলাম এমন ফরম্যাট, সেখানে দুজনই দু’জনের জন্য স্যাক্রিফাইস করা শেখে। দু’জনই যেখানে দু’জনের জন্য ছাড় দেবার মানসিকতা রাখে, সেখানে সংঘর্ষের সুযোগ কোথায়?

ধর্ষণ vs বৈবাহিক ধর্ষণ: ভিতরের কাহিনী

ধর্ষণের সংজ্ঞা এখন ব্যাপক, যা শুধু পেনিট্রেশনের ভিতর সীমাবদ্ধ নেই। সেদিকে আলাপ নেব না। প্র্যাকটিক্যালি ধর্ষিতার মেডিকেল পরীক্ষা বাস্তবতা যা বুঝা যায়, ধর্ষণ- অনেকগুলো অপরাধের সমষ্টি। অসম্মতিতে সহবাসই শুধু নয়; অসম্মতির দরুণ শারীরিক প্রহার, চড়-থাপ্পড়-জখম, বাধা দেবার চেষ্টার (ক্রস লেগ) বিপরীতে প্রচণ্ড আঘাত করা, যোনিপথ জখম- এই অপরাধ কয়টির সম্মিলিত রূপ হল ধর্ষণ। নিজ স্ত্রীর সাথে সহবাসটা অসম্মতিতে করার অনুমতি থাকলেও বাকি কয়টা বড় ধরনের অপরাধ।

আর স্বাভাবিক তো এটাই যে, নিজ স্বামীর প্রতি স্ত্রীর বাধা থাকবে দুর্বল, সাময়িক; ফলে সহবাসে অসম্মতি থাকতে পারে, তবে প্রতিরক্ষা থাকবে না। ফলে ধর্ষণের পাশবিকতা বা ভায়োলেন্স এখানে অনুপস্থিত। মনে অসম্মতি থাকলেও দৈহিক প্রতিরোধ প্রত্যাহার করে নেবে। ফলে স্ত্রীর ক্ষেত্রে ‘ধর্ষণ’ শব্দটাই অযথার্থ। মানে অসম্মতিতে সহবাস আর ধর্ষণ কখনোই এক জিনিস না। পশ্চিমা নারীবাদী লিবারেল নৈতিকতার কাগুজে সংজ্ঞায় তা পড়তে পারে, কিন্তু বাস্তবতা বিবর্জিত এসব ‘এসিরুম ডেফিনেশন’-এর সাথে ইসলামের কোনো সম্পর্ক নেই। এবং এসব কাগুজে ধারণা মানতেও আমরা বাধ্য না।

তবে যেটা হতে পারে, স্বামী জালেম হতে পারে। জুলুমের অংশ হিসেবে জোরপূর্বক সহবাস হতে পারে। ইসলাম সেটাকে জুলুম হিসেবেই দেখবে, আলাদা করে ধর্ষণ হিসেবে নয়।

আসল ঘটনাটা কী হয়েছে এবার আসি। বাইরে অপরিচিত মানুষ ধর্ষণ করে যাচ্ছে, ঠেকানোর বালাই নেই। স্বামীর ধর্ষণ নিয়ে কেন মাথাব্যথা। সারা পৃথিবীতে ধর্ষণের হার বাড়ছে। পুঁজিবাদ নিজ মুনাফা ও কম পারিশ্রমিকের লোভে নারীকে ঘরের বাইরে এনেছে, শ্রম নেবার জন্য বিয়ের বয়স পিছিয়েছে। সিনেমা ব্যবসা, পর্নব্যবসা দিয়ে মাঝের বয়সটা কাভার দেয়ার চেষ্টা করেছে। অনিবার্যভাবে শুরু হয়েছে ধর্ষণের মহামারি। পতিতাব্যবসা ইন্ডাস্ট্রিতে পরিণত করেও ঠেকানো যাচ্ছে না, উল্টে পতিতারা পর্যন্ত ধর্ষিতা হচ্ছে। #MeToo আন্দোলনে উঠে আসছে শিক্ষাক্ষেত্রে ও কর্মক্ষেত্রে নারীর অসহায়ত্ব। সচেতন বোদ্ধারা বিষয়টা নিয়ে ভাবছে, বাইরে নারী নিরাপদ নয়। এখন এটা কাভার দেয়ার জন্য পরের তুরুপের তাস হল, নারী তো ঘরেও নিরাপদ নয়। তোমরা নারীকে ঘরে নিতে চাচ্ছ, তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে চাচ্ছো, ঘরে স্বামীর কাছেও তো নারী নিরাপদ নয়।

আমরা আগেই দেখলাম, খোদ নারীবাদীরাই ‘বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে’ সম্মতি নিয়ে সঙ্গমকে ধর্ষণ বলছে না। তাহলে ‘বিয়ে করে’ (আমাদের ‘নিকাহ’ মানে সঙ্গমের সম্মতি) সঙ্গমকে ধর্ষণ বলা হচ্ছে কেন? তাহলে কি স্বামীকে প্রতিবার আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মতি নিতে হবে। হয়ত অদূর ভবিষ্যতে আইন থেকে বাঁচতে স্বামীকে প্রতিবার লিখিত সম্মতিপত্রও নিতে হতে পারে। অবশ্যই স্বামীকে স্ত্রীর সমস্যা মানসিকতা বুঝতে হবে, কিন্তু স্থায়ী অনুমতিপ্রাপ্ত স্বামী স্ত্রীকে জোর করাও ধর্ষণ, আবার অপরিচিত লোক জোর করে লুটে নেয়াও ধর্ষণ? এদের এইসব কথাবার্তায় একদিন ‘ধর্ষণ’ শব্দটাই খেলো হালকা হয়ে যাবে। এসব রূপকথায় আমাদের সায় নেই।

তাত্ত্বিক কথাবার্তা

মধ্যবিত্ত শিল্পপতি অংশটার উৎপত্তি সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতকের বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলন থেকে (এনলাইটেনমেন্ট)। ব্যক্তির সংজ্ঞা, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ, স্বাধীনতা, সমতা, উদারনৈতিকতা— ইত্যাদি মতবাদ যখন অর্থনৈতিক সেক্টরে প্রয়োগ করা হল— জন্ম নিল পুঁজিবাদ বা ধনতন্ত্র। যার বিকাশে বিকশিত হল এই মধ্যবিত্ত শিল্পপতিরা, উপনিবেশ ও শিল্পবিপ্লবের মওকায়। এরাই ঘটালো পুরনো সামন্ততন্ত্রের পতন, জমিদারেরা ছিল এদের বিকাশে বাধা। কারণ এই বণিকেরা ছিল উৎপাদক প্রজা আর শোষক জমিদারের মাঝখানে, যাদেরকে জমিদারেরা নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করত, ব্যবসায় বিধিনিষেধ-খাজনাপাতি আরোপ করে। [1]

পত্তন করল গণতন্ত্রের, যাতে নিজেদের ব্যবসার অনুকূলে শাসনযন্ত্রকে ব্যবহার করা যায়। সেই সাথে নিজেরাও সরাসরি মন্ত্রী ইত্যাদি হবার দ্বারা শাসনে হস্তক্ষেপ করা যায়। খুব স্বাভাবিকভাবেই এনলাইটেনমেন্ট থেকে আসা মূল্যবোধগুলো এই শ্রেণীটার পক্ষে কাজ করে। কীভাবে করে—

ক. আগের ধর্মভিত্তিক নৈতিকতা ভোগকে নিরুৎসাহিত করে। সুতরাং ‘ব্যক্তি’ নতুন সংজ্ঞা দাও: সে নিজের নীতি নিজে ঠিক করে সে human. (humanism, liberal ethics)
খ. পরিবারের জন্য, সমাজের জন্য মানুষ ত্যাগ করে, sacrifice করে, যা ভোগকে কমায়। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য আদর্শের দ্বারা তৈরি হবে স্বার্থপর মানুষ, যার ফোকাস হবে শুধু নিজের ভোগ।
গ. স্বাধীন মানুষ নিজের ইচ্ছার দাসত্ব করবে। ফলে স্বাধীনতা ভোক্তা বৃদ্ধি করবে। পরাধীন ব্যক্তির ভোগ সীমিত।
ঘ. সমতা ও এ থেকে উৎসারিত অন্যান্য আইন প্রত্যেকের ভোগের অধিকার নিশ্চিত করবে।

এভাবে এনলাইটেনমেন্টের পুরো কাঠামোটাই পুঁজিবাদের পক্ষে কাজ করবে। ভোগ বাড়লে ক্রেতা বাড়বে, ক্রেতা বাড়লে পণ্য বেশি বিক্রি হবে, বেশি বিক্রি মানে বেশি মুনাফা— পুঁজিবাদ। যা যা এই ভোগকে নিরুৎসাহিত করে: ধর্ম, পরিবার, গোষ্ঠী, সমাজ— সবকিছুকে ভেঙে অকার্যকর করে দিতে পারলে লাভেই লাভ। আর রাষ্ট্র হবে সর্বশক্তিমান, যা সযত্নে রক্ষা করবে পুঁজিপতিদের অবাধ ব্যবসার স্বার্থ। এরই অংশ হিসেবে ‘বৈবাহিক ধর্ষণ’ কনেসেপ্টের আমদানি। পশ্চিমের ভেঙে পড়া পরিবার, ভেঙে পড়া সমাজ ও ব্যর্থ রাষ্ট্র- এসব বড় বড় মাছকে ঢাকার জন্য ‘বৈবাহিক ধর্ষণ’ আরেক পদের শাক। না বুঝলে তেজপত্র ইত্যাদি।

বই: মানসাঙ্ক, সন্দীপন প্রকাশনী, ডা. শামসুল আরেফীন